অসময়ে অশুভ বসন্ত
রাজলক্ষ্মী মৌসুমী
(গল্পটা কাল্পনিক, তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে।)
প্রেম, ভালোবাসা, কোন বয়স, সময় নিয়ে আসে না। যে কোন সময় মনের অজান্তে ভালোবাসা হতে পারে। এখন ফোন হলো মাধ্যম। চিঠির যুগ এখন আর নেই। সেল ফোন চালু হওয়ার পর থেকে ল্যান্ড ফোনের কদরটা একদম কমে গেছে। মোবাইলে টাকা না থাকলেও ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করার ইচ্ছা হয় না। সেল ফোনটা একান্তই নিজের। সব দিক দিয়ে একদম নিরাপদ।
এই সেল ফোনের মাঝেই চিত্রার অশনি সংকেত লুকিয়ে ছিলো।
চিত্রা যখন এম,এস সি পরীক্ষা দিচ্ছিল ঠিক তখনি হঠাৎ তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। বাবা একজন সরকারী কলেজের শিক্ষক ছিলেন। চিত্রা কোন রকমে পরীক্ষা শেষ করে। বাবার অফিসের কাগজ পত্র ঠিকঠাক করে নিল। বাবার পেনশনের টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থাটা আগে করলো। সংসারের চিন্তা শুরু হলো। ছোট দুই ভাই বোনের পড়াশুনা চালাতে হবে। চাকরির সন্ধানে নানান জায়গায় চেষ্টা শুরু করলো। রোহন চিত্রার ক্লাসমেইট ছিলো। কলেজে দুই বছর এক সঙ্গে পড়েছে। এর পরে রোহনের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। সে চলে গেলো চিত্রা রয়ে গেলো।। মনে মনে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো চিত্রাকে কিন্তু প্রকাশ করেনি কখনও। চিত্রার চাকরির ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে রোহন। একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি যখন হলো রোহন তখন ভাবলো এখন বলা যায় কথাটা। বলে দেখি চিত্রা কী বলে।
চিত্রাকে বলা মাত্রই ক্ষেপে গেলো। আপনি কী পাগল? আমার ছোট একটি ভাই আাছে ওকে কে দেখবে? ওকে কে মানুষ করবে? আপনিই বলুন? মা ভালো সেলাই জানতেন। উনিও সংসারের হাল ধরলেন। বাবার পেনশন, মায়ের সেলাইয়ের উপার্জন,চিত্রার উপার্জনে সংসার ভালো ভাবেই চলছিল। দিনের পর দিন যাচ্ছে কিন্তু নিজের প্রতি কোন নজর নেই চিত্রার। ভাইকে ডাক্তার বানাতেই হবে। যখন সত্যি সত্যি ডাক্তার হয়ে গেলো তখন তার আনন্দ দেখে কে। চিত্রার মনে অনেক আনন্দ।তার বাবার মনের আশা ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবে। পূর্ণ হলো সেই আশা। তাই তার জীবনের সার্থকতা । চিত্রার মা এখন মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। চারদিকের চেনা জানা আত্মীয় স্বজনদের বলেছেন ছেলে দেখার জন্য। মেয়ে তো রাজীই হলোনা। রোহনও ডাক্তারী পাশ করার পর চিত্রার বাড়ীতে আসছিলো। চিত্রার মাকেও রোহন তার মনের কথা জানালো কিন্তু চিত্রা তার মাকে বললো আমার সেই বয়স নেই মা তুমি বারণ করে দাও। মেয়ে যখন কিছুতেই রাজী হলো না মা তখন চুপ হয়ে গেলেন।
তারপর মা ভাবলেন মেয়ে যখন বিয়ে করবেই না তাহলে ছেলেকে বিয়ে করানোর চিন্তা করি। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে যাবেন। এটা মায়ের অভিমানের কথা। ছেলের তো পছন্দের মেয়ে আছে। সেই মেয়েটি ব্যাংকার। চিত্রা তার ভাইকে বললো এখন ঘরে বৌ আনো। মা কিন্তু বৌ দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছেন। চিত্রা সব জানতো।
মায়ের কাছে সব ঘটনা বললো, মাও রাজী। তারপর সব কথা বার্তা শেষ করে ধুমধাম করে বিয়ে দিলো চিত্রা। বৌ আসলো ঘরে শান্তির সংসার চলছে সুন্দরভাবে। এক বছর যেতে যেতেই চিত্রাকে বললো দিদি তুমি এখন বিশ্রাম নাও। চাকরী ছেড়ে দিয়ে গান বাজনা করো দিদি। তুমি এই সংসারের জন্য অনেক করেছো। এখন বয়স থাকতে থাকতে চাকরী ছেড়ে দাও দিদি প্লিজ আমার কথাটা রাখো। চিত্রা চিন্তা করে দেখলো
ছোট ভাই বৌ এতো করে বলছে যখন তবে কথাটা খারাপ বলেনি। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো চাকরী ছেড়ে দেবে। ৫/৬ বছর আগেই সে স্বইচ্ছায় অবসর নিয়ে নিলো।
তারপর শুরু হোল চিত্রার জীবনে নতুন অধ্যায়।যেদিন অবসরে গেলো সেদিনই ছোট ভাই বৌ সেল ফোন কিনে নিয়ে আসলো। বৌ এসে বললো দিদি তুমি এতদিন চাকরী করলে নিজের জন্য কোনদিন কিছু কিনোনি। একটা মোবাইল পর্যন্ত তোমার নেই। আমার অবাক লাগে। আজ থেকে তোমার কাজ হলো গান করা আর মোবাইলে ফেইসবুক ব্যবহার করা। আমি সব কিছু তোমায় শিখিয়ে দেবো।
চিত্রা পরিবারের জন্য যেমন শ্রম দিয়েছে ঠিক তেমনি মনের মতো বৌ পেয়েছে।ছোট ভাই বৌ যেমন দেখতে সুন্দরী তেমনি ভালো।চিত্রাকে খুব সম্মান করে ভালোও বাসে। ফেইস বুকের সব নিয়ম কানুন শিখার পর চিত্রার ভিতরে এক চিন্তা আসলো। সে ভাবছে সে কোথায় ছিলো এতোদিন? অনেক সময় পার করার মতো যন্ত্র। মন খারাপ থাকলেও মন ভালো হয়ে যায়।
অনেক পুরোনো বন্ধু পেলো নতুন নতুন বন্ধুও জুটলো। ১/২ বছর পর তার এক নতুন বন্ধু তাকে অনেক প্রশ্ন করলো। লোকটি জানতে পারলো চিত্রা অবিবাহিতা। তারপর উনি বললেন আমার নাম শোভন আমি আমেরিকাতে থাকতাম।বিয়ে করেছিলাম কিন্তু বাচ্চা হওয়ার সময় আমার স্ত্রী মারা যায়, তারপর আমি বিদেশ থেকে চলে আসছি বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো। এখানে এসে মার্কেট দিয়েছি, গার্মেন্টস আছে একটি। চিত্রাকে বললো শোভন দেখো চিত্রা তোমারও বয়স হয়েছে আমার বয়স হয়েছে।একটা কিছু বলো আমায়। আমি একদম একা। দুজনে মিলে সংসার করি। একসাথে থাকি।চিত্রা ঘুরে বেড়াবো সারা বিশ্ব। তুমি মত দাও আমায় আমি তোমার মাকে আর ভাইকে জানাই।
চিত্রা কিছুদিন সময় চাইলো।২/৩ মাস পর চিত্রা তার মাকে বললো। ভাইকেও বললো। সবাই খুশী। আর দেরী না করে ভাই চলে গেলো শোভনের কাছে। শোভন তো মহা খুশী। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হলো। চিত্রা তার মতামত জানালো বিয়েতে কোন ধুমধাম করা যাবে না।পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে। মন্দিরে মালা বদল হবে। শোভন শুনে বললো ঠিক আছে চিত্রা যেভাবে চায় সেভাবেই হবে।। বিয়ে হয়ে গেলো । মায়ের আনন্দ আর ধরেনা। মেয়ের অনেক বয়স হয়েছে তারপরেও যে এতো ভালো ছেলে পাওয়া গেছে সেটা আমাদের ভাগ্য। ঠাকুর ওদেরকে ভালো রাখেন যেনো। মায়ের আশীর্বাদ শুনে শোভন বললো আমার মাও আমাকে এভাবেই আশীর্বাদ করেছিলেন কিন্তু আমার আগের স্ত্রী তো মারা গেলো মা। চিত্রার মায়ের মনে একটু ধাক্কা খেলো। মেয়ের জামাইকে বললেন আজকের দিনে এমন কথা বলতে নেই বাবা। শোভন বললো না মা কিছু হবে না চিন্তা কোরবেন না। চলে গেলো চিত্রা বরের বাড়ী। শোভনের মা বাবা কেউ নেই।সে একমাত্র আদরের সন্তান ছিলো। কিন্তু আজ তার কেউ নেই। শোভন একদম একা। গ্রামের বাড়ীতে চাচা চাচীরা আছেন। চিত্রাকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করলো। নিজের গ্রামের বাড়ীতেও নিয়ে গেলো। এভাবে এক বছর কেটে গেলো। চিত্রা এতো আদরে সোহাগে আছে তারপরেও মা ভাইয়ের জন্য তার মন কাঁদে। প্রতিদিন শোভন চিত্রাকে মায়ের কাছে নিয়ে যায়।
শোভন অফিস থেকে এসেই চিত্রাকে বললো একটা খুশীর খবর আছে।আমরা মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছি আগামী সপ্তাহে। চিত্রা কোন আনন্দ প্রকাশ করলো না। শোভনের একটু মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। এতো ভালো একটা আনন্দের খবর দিলাম চিত্রার কোন প্রতিক্রিয়া নেই কেনো? এটা নিয়েই ভাবছে শোভন। চিত্রা বললো কী হয়েছে মন খারাপ কেনো? শোভন বললো নাগো কিছু হয়নি। চলো শোভন মায়ের বাড়ীতে যাই। কয়েকটা দিন থেকে আসি মায়ের বাড়ীতে।। শোভন বললো না তুমি থেকে আসো। আমি এদিকে সামলাই। ঠিক আছে তুমি যাও আমেরিকা যাবার দুইদিন আগেই চলে আসবে কিন্তু। চিত্রাও বললো ঠিক আছে চলে আসবো। ক’দিন থেকে চলে গেলো চিত্রা। ছোট ভাই গেলো তাদের বিদায় দিতে। দুই মাস থাকবে শোভন বললো। আমেরিকাতে এক মাস অনেক ঘোরাঘুরি করার পর হঠাৎ টিভিতে খবর শুনার পর জানতে পারলো করোনা ভাইরাসে চীনে মানুষ মারা যাচ্ছে।আর কিছুদিন পর জানলো বিভিন্ন দেশেও এই রোগ ছড়াচ্ছে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো দেশে চলে আসবে। আমেরিকা থাকা অবস্থাতে কিছু সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
মাস শেষ না হতেই বাংলাদেশে চলে আসলো।এসেই দুজন মিলে ঘর সংসারের কাজে লেগে গেলো। কতদিন ছিলোনা বাড়ীতে তাই ঘর দুয়ার নোংরা হয়ে আছে। দেশে এসেও টিভিতে খবরের কাগজে জানলো ধীরে ধীরে মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। তারপর শুরু হলো লকডাউন। কী আর করা বাড়ীতেই থাকা।
কাজের মহিলা অনেক আগে থেকেই শোভনের বাড়ীতে থাকে। দুইমাস এই মহিলা গ্রামের বাড়ীতে চলে গেছিলো। শোভন ওরা আসতেই সে চলে আসছে। চিত্রার ভাই ডাক্তার সারাদিন রোগীদের সেবা করার পর স্নান সেরে বোনকে দেখতে আসলো। এসেই একটু পর চলে গেলো।সবাইকে সাবধানে থাকতে বললো। কয়েকদিন পর শোভনের জ্বর, সর্দি গলা ব্যথা, একটা অস্থির ভাব। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন পর চিত্রাও অসুস্থ হয়ে পরলো। দুজন দুই ঘরে ছিলো দুই রাত। চিত্রার ভাই খবর পেলো ওদের কথা শুনেই হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করালো। যা ভাবা তাই হলো। করোনাতে আক্রান্ত হলো দুজনেই।চিত্রার ভাই ভাবলো নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে কাল মাকে আর স্ত্রীকেও পরীক্ষা করাবে।চিত্রার ভাইয়ের Result ও পজিটিভ আসলো। বাড়ীতে চলে গেলো এই রোগের যা যা করণীয় সব কিছুই চিত্রা আর শোভন করেছে। কিন্তু বিধি এতই বাম ১৪ দিনের মধ্যেই শোভন চলে গেলো চিত্রাকে ছেড়ে।এই শোকে আর শ্বাসকষ্টে ২/৩ পর সেও মারা গেলো। চিত্রার মা বেঁচে থেকেও মৃত। চিত্রার ভাই ভালো হলো। চিত্রার ভাই ও তার স্ত্রী মূল্যবান সম্পদ হারালো।
তারপর এই দুঃসংবাদ জানানোর জন্য রোহনকে ফোন করলো কেউ ফোন ধরছিলোনা দেখে আবার ফোন করলো তখন একজন মহিলা ধরলো। ধরে বললেন তিনি তো নেই। এক সপ্তাহ আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন উনার স্ত্রীই জানিয়েছেন।। চিত্রার জীবনের পরিণতি কী হলো? বিয়ে না হলে তো মায়ের কাছে, ভাইয়ের কাছে, থাকতো। ঢোখের সামনে মারা যেতো। তাদের কেউ দেখতেও পেলো না ছুঁতেও পারলো না। ভাগ্যের লিখন কী কেউ ফেরাতে পারে??