বদলে যাওয়া পৃথিবী, পর্ব-১
:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::
ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে শতবর্ষ পূর্বে চার্লস ডিকেন্স তাঁর ‘A Tale of Two Cities’ উপন্যাসে লিখেছেন, ” It was the best of times; it was the worst of times”। করোনার কারণে সৃষ্ট অবস্থাকে একটা সংকট ধরলে এ কথা বলা যায় কিনা বলা কঠিন। আপাতত সবচেয়ে খারাপ সময় আমরা পার করছি এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিছু সুযোগ হয়তো আসবে সেটা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আজকে করোনা সৃষ্ট সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক সংকট ও এর রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য কি হতে পারে তা নিয়ে সাদামাটা একটি আলোচনার অবতারণা করব। এগুলোর কোনটাই একেবারে অকাট্য বক্তব্য হিসেবে ধরে নেয়ার জন্য লিখছি না। (আমি কিছু লিখলে সেটা অনেকেই, বিশেষ করে আমার ছাত্ররা অকাট্য বলেই ধরে নেয়। কেউ কেউ আমাকে মার্কেটিং গুরু বলে অভিহিত করে, এটা অনেকটা বরিশালের ‘গাবখান’ খালকে ‘ইংলিশ চ্যানেলের’ সাথে তুলনা করার মতো। এতে আমি বিব্রত হই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে যেমনটি বলেছেন, ” আমাদের পূর্বাঞ্চলে প্রবলা প্রকৃতি পদতলে অভিভূত ভাবে বাস করিয়া প্রত্যেক মানুষ নিজের অসারতা ও ক্ষুদ্রতা অনুভব করে, এইজন্য কোন মহৎ লোকের অভ্যুদয় হইলে তাহাকে স্বশ্রেণী হইতে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া দেবতা পদে স্থাপিত করে। তাহার পর হইতে তিনি যে কয়টি কলা বলিয়া গিয়েছেন বসিয়া বসিয়া তাহার অক্ষর গণনা করিয়া জীবন যাপন করি; তিনি সাময়িক অবস্থার উপযোগী যে বিধান করিয়া গিয়াছেন তাহার রেখা মাত্র লংঘন করা মহাপাতক জ্ঞান করিয়া থাকি।” )
করোনার টিকা বের হবে কিনা, বের হলেও সবার কাছে এটা পৌঁঁছতে কতদিন সময় লাগবে এটা কেউ বলতে পারছে না। গুটি বসন্তের টিকা বের হওয়ার পরেও ১৮৪ বছর সময় লেগেছিল পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত নির্মূল করতে। অনেক রোগের টিকাই বের হয়নি। অতএব আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আরো অনেকদিন আমাদের করোনা নিয়েই থাকতে হবে। করোনার কারণে জীবন থেমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেমে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে পড়তির দিকে ধাবমান, এর মধ্যেও যারা বেঁচে আছে তারা কিন্তু কেনা-বেচা করেই বেঁচে আছে। একক কোন ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অর্থনৈতিক সামষ্টিক চলকগুলো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। যে সকল চলক নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয় তার সাথে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে হবে। যে যত দ্রুত “নিউ নরমাল” এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে সেই টিকে যাবে। অনেক কিছুই আগের মত থাকবে না, বদলাতে আমাদের হবেই। এক্ষেত্রে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির একটি উক্তি স্মরণ করছি, “গতকাল চালাক ছিলাম তাই পৃথিবীটাকে বদলাতে চাইতাম, আজ বুদ্ধিমান হয়েছি তাই নিজেকে বদলাতে চাই “।
মন্দার প্রভাবে বেকারত্ব বাড়বে। কিছু ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এবং কর্মীদের চাকরি চলে যাবে। কিছু ব্যবসায় বেঁচে থাকার জন্য লে-অফ হবে। নতুন করে অনেকেই চাকরি পাবে না। আত্মকর্মসংস্থানের চেষ্টাকারীরা তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ক্রেতার অভাবে বেকার হয়ে পড়বে। জ্বালানির দাম কমে যাওয়ার কারণে খরচের চাপে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি হয়তো কম হবে। অনেকেই কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হবে। যারা এখন ওভারটাইম কাজ করছে তাদের ওভারটাইম কাজ করার সুযোগ চলে যাবে। বেকারত্ব কর্মশক্তির মনোবল ও স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করবে। দীর্ঘ মন্দা সামাজিক সমস্যা তৈরি করবে। সামাজিক অস্থিরতা যেমন সন্ত্রাস দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাড়বে, বাড়বে স্থানান্তরিত ক্রোধ।
আলজেরীয় বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক Frantz Fanon ১৯৫২ সালে প্রকাশিত তাঁর বই, “Black Skin White Mask” বইয়ে যেমনটি বলেছেন, ” দীর্ঘদিন দুর্দশার মধ্যে থাকলে সমাজে হিংসা বেড়ে যায়। মানুষ যখন মূল কারণে হাত দিতে পারে না বা খুঁজে পায়না তখন সে চারপাশের উপর আক্রোশ বোধ করে।” গন বেকারত্বের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য দেশের সামাজিক বুননকে (social fabric )হুমকির মুখে ফেলবে। বেকারত্বের কারণে দক্ষতা অর্জন , যা ‘নিউ নর্মালে’ কাজ পাওয়ার জন্য আবশ্যকীয়, সে সুযোগ সবাই পাবে না। যা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দেখা দিবে। অনেকেই কর্ম বাজারের বাইরে চলে যাবে। করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও এই আশঙ্কার কথা বলছে।আমাদের দেশে কৃষিজ উৎপাদন অক্ষুন্ন থাকায় খাদ্য মজুদ ভালো। তাই সরকারি লোকেরা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদেরকে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত অমর্ত্য সেনের ” Poverty and Famine ” বইয়ের মূল প্রতিপাদ্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ” দুর্ভিক্ষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কিছু লোকের না খেতে পাওয়া। এর বৈশিষ্ট্য কিন্তু খাবারের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকা নয়। ” শত প্রণোদনা দেওয়ার পরও অনেক কিছুই সরকারের হাতে থাকবে না। অথচ বিরোধী রাজনীতিকরা সবকিছুর জন্য সরকারকেই দায়ী করবে। আমেরিকার প্রাবন্ধিক, কবি,দার্শনিক এবং অনুবাদক Henry David Thoreau ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বই “Civil Disobedience”- এ নাগরিক অবাধ্যতার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রের অন্যায্য আচরণকেই দেখিয়েছেন।
মন্দায় বৈষম্য এবং আপেক্ষিক দারিদ্র্য আরো বাড়বে। কর্মহীনতাই হবে বৈষম্য বাড়ার অন্যতম কারণ। করোনা পরবর্তী দুনিয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে যাবে। অনেক কোম্পানি ঋণ খেলাপি হয়ে দেউলিয়া হবে। এই প্রবণতা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। গাড়ি ভাড়ার কোম্পানির বিশ্ব নেতা Hertz দেউলিয়া ঘোষণার প্রস্তুতি শুরু করেছে। যা ছয় মাস আগে কল্পনাও করা যায়নি। বিলাস সামগ্রী, বিনোদন সংশ্লিষ্ট সেবা ও সামগ্রী উৎপাদন সবচেয়ে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়গুলো বাধ্য হয়ে মূল্যযুদ্ধ ও খরচ কমানোর যুদ্ধে লিপ্ত হবে। আগ্রাসী মূল্যযুদ্ধ ব্যবসায়ীদের মুনাফাযোগ্যতা আরো কমিয়ে দিবে। মুনাফাযোগ্যতা কমে গেলে খরচ কমানোর চেষ্টা করবে ব্যবসায়ীরা। অলাভজনক পণ্যও ব্যবসায় গুটিয়ে ফেলবে। ব্যবসার খরচ কমাতে গিয়ে কর্মী কমাবে , বেকারত্ব আরো বাড়বে।
করোনা সৃষ্ট মন্দার কারণে দুনিয়া বদলে যাবে, বদলে যাবে মানুষ। গত দুই দশক ধরে মানুষ যা যা ভোগ করে আসছে তার অনেকগুলো সে পরিহার করবে। এটা যে শুধু তারা আয় কমে যাওয়ার কারণেই করবে তা কিন্তু নয়। স্থায়ী পণ্য ক্রয় বা স্বেচ্ছাধীন খরচ(flexible expenditure) সামর্থের উপর নির্ভর করে না, সামর্থ্য ব্যয় করার ইচ্ছের উপরও নির্ভর করে। অনেক কাজের লোক, মালি, ড্রাইভার নিয়ে বিলাসী জীবনের সামর্থ্য থাকলেও ‘ নিউ নর্মাল ‘ লাইফে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণেই মানুষ তার নিজের বাসায় প্রতিদিন বাইরে থেকে আসা-যাওয়া করা লোকদের পরিহার করবে। ‘লক ডাউন’ এর সময় অভ্যাসে পরিণত হওয়া নিজের কাজ নিজেই করতে সচেষ্ট হবে, যেমনটি ইউরোপ আমেরিকা করে। ওইসব দেশে গৃহস্থালী কাজের লোক পাওয়া যাযনা ; পেলেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে হয়তো অতি বেকারত্বের কারণে কম মজুরিতে গৃহস্থালী কাজের জন্য লোক পাওয়া যাবে, তারপরও বস্তিতে থেকে কয়েকটি বাসায় কাজ করে এমন গৃহস্থালী কর্মীদের চাহিদা কমে যাবে। অতি সামর্থ্যবানরা ‘ইন-হাউজ’ কাজের লোক হয়তো ১/২ জন রাখবে।
প্রযুক্তির প্রভাবে এমনিতেই আমরা সবাই মিলে আলাদা হয়ে যাচ্ছি (alone together), অর্থনৈতিক কারনেও আমাদের সামাজিক পরিসর আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। লকডাউন , আইসোলেশন আমাদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতির বিপরীত। মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আড্ডা, চৌমুহনীতে, পুকুরঘাটে বসে দিনে কমপক্ষে ২/৪ ঘন্টা আড্ডা দেয়া আমাদের গ্রামাঞ্চলের নৈমিত্তিক রুটিন কাজ। সপ্তাহে দুই হাটের দিনে বিনা কারণে বা কেবলমাত্র পান-সুপারি কিনতে দুপুরে বাজারে গিয়ে রাতে ফিরে আসা, বাজারকে বিনোদন ও সামাজিক মিলন ও আদান-প্রদানের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় দেখা যায় না। আমাদের জীবনের তিনটি বলয়- পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত। পশ্চিমী দুনিয়ায় সমাজ বলয়টি দুর্বল, অন্তত আমাদের দেশের মতো জোরালো নয়। সেখানে জীবনের বলয় দুইটি, পরিবার ও কর্মক্ষেত্র। পরিবারেই তাদের স্বর্গ, সমাজ নেই। জাপানে অবশ্য কর্ম ও কর্মক্ষেত্রই তাদের স্বর্গ। পরিবর্তিত দুনিয়ায় আমরাও কি আমাদের সামাজিক বলয় ধরে রাখতে পারব। (চলবে)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।