প্রচ্ছদ

যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু এখন ‘টপ অব দ্য টাউন’

  |  ১৪:৫৩, জুন ০৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: আনসার উদ্দিন খান পাঠান ::

পৃথিবীব্যপী করোনা মহামারির সংবাদ ছাপিয়ে এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস পুলিশের হাতে কৃষ্ণবর্ণের নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু এক নম্বরে চলে এসেছে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশ শহরে কারফিউ জারি করতে হয়েছে৷ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিকের এপাড়ে প্যারিস এবং লন্ডনেও। ১৯৬৮ সনে মার্টিন লুথার কিং এর মৃত্যুর সময়ে সংঘটিত বিক্ষোভের ব্যাপকতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এটি।
জর্জ ফ্লয়েডের ব্যক্তিগত ইতিহাস অবশ্য সুবিধার নয়। চুরি এবং মাদক অপব্যবহারের জন্য পুলিশ তাকে বার কয়েক গ্রেফতার করেছে। ২০০৭ সনে ডাকাতির দায়ে মিনোসেটা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর বিচারশষে ৫ বছর জেলও কেটেছেন। করোনা সংকটে তাঁর ড্যান্সক্লাবে বাউন্সারের চাকরিটাও গেছে সম্প্রতি। মেনিয়াপোলিস শহরের শিকাগো রোডের ‘কাপ ফুডস’ নামের দোকানে বিশ ডলারের নকল নোট দিয়ে সিগারেট কেনেন। দোকানদারের অভিযোগের ভিত্তিতে আট মিনিটের মাথায় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ফ্লয়েডকে গ্রেফতার করে। আমেরিকাতে গ্রেফতার মানেই হল হ্যান্ডকাফ পরানো। উঁচুনিচু, সাদা কালো, গুরুতর মামুলি এর বাছবিচার নেই। সি এন এনের লাইভ সংবাদ প্রচাররত সাংবাদিককেও হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় অবলীলাক্রমে। এক্ষেত্রেও পুলিশ যথানিয়মেই এগিয়ে যায়। হ্যান্ডকাফ পরা ফ্লয়েডকে যখন পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলতে যাবে তখনই সে বেঁকে বসে। উত্তরে পুলিশ অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া গ্রেফতারে বলপ্রয়োগের বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ীই ফ্লয়েডকে মাটিতে উপুড় করে তাঁর ঘাড়ের উপর হাটু গেড়ে বসে। মিনোসেটা পুলিশ হ্যান্ডবুক মোতাবেক এভাবে চেপে বসার প্রশিক্ষণ পুলিশকে দেয়া হয়েছে। শক্তিপ্রয়োগে প্রয়োজন হলে শ্বাসপ্রশ্বাসের পথ খোলা রেখে এই ভংগিমায় ঘাড়ের উপর চেপে বসা যেতে পারে । আট মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড শেতাংগ অফিসারটি পকেটে হাত রেখে নির্বিকার বসে ছিল যন্ত্রনাকাতর ফ্লয়েডের ঘাড়ে। পথচারীদের অনুনয় বিনুনয় কানেই তুলেনি অফিসার সোভেস। সহকর্মীরাও তাকে দিয়েছে সমর্থন আর পাহারা। ছয় মিনিটের মাথাতেই ফ্লয়েড নিস্তেজ হয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয় তাকে। আইনানুগ আটকের সময় অনভিপ্রেত অবস্থায় ব্যক্তির মৃত্যু হতেই পারে, সেটাও আইনবলে স্বীকৃত। প্রাথমিক পোষ্ট মর্টেম রিপোররেটেও বলা হল, ঘাড়ে চেপে বসার জন্য ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়নি, তার কারণ ছিল ফ্লয়েডের গ্রেফতারপূর্ব রোগাক্রান্ত হৃদপিন্ড আর ড্রাগসের নেশা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল পুলিশ সবকিছুই আইনবলে তার উপর অর্পিত ক্ষমতা ও বিধান মেনেই করেছে৷
সমস্যাটা তাহলে কোথায়? এক পথচারীর তোলা ঘটনার কয়েক মিনিটের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দ্রুত উত্তাল করে দিল আমেরিকা। সে ভিডিও দেখে, কি সাদা কি কালো কোন আমেরিকানই আর ভাবেনি পুলিশ কাজটা ঠিক করেছে। পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূল গর্জে উঠে প্রতিবাদে। সেই চেপেবসা অফিসার এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাকি তিন পুলিশের চাকরি গেল এবং সবার বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি খুনের মামলা রুজু হল। প্রমাণ হলে বার বছরের জেল ।
আইন এবং প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলের নির্দেশ মেনে চলা সত্বেও পুলিশের ভুলটা কোথায় ছিল? ইউ এন মিশনে কিছু সময় এবং বর্তমানে দেশে পুলিশ প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত থাকার কিঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই বলপ্রয়োগের মত তিক্ত কাজে সবসময় সবদেশে পুলিশের কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। করোনা মোকাবেলায় পূর্ব আর পশ্চিম গোলার্ধের সকল কালো-বাদামী-সাদা মানুষ যেমন এক পলিসি নিয়েছে, পুলিশের এই বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবখানে প্রায় একই পলিসি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, যত ক্ষোভই থাক , পুলিশ অবলুপ্ত করা যাবে না। এটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংগ। প্রয়োজনে তাকে কেবল সংশোধনের কথাই মনে করিয়ে দেয়া যায়।
বলপ্রয়োগে পুলিশ যা মাথায় রাখতে পারে :

১. Discretion : বিচারবুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগ। আইনবলে অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী পুলিশের মাঠপর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আইনের লম্বা হাতের প্রপ্রয়োগ নয়, অফিসারের প্রজ্ঞা, বিবেচনা , পরিস্থিতির তাৎক্ষনিক বিশ্লেষণও অত্যন্ত জরুরী। হ্যান্ডকাফ বাধা অবস্থায় তাকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করার জন্য ঘাড়ে চেপে বসারএই কসরত কি সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল?

২. Use of Excessive Force : ফ্লয়েড মোট এগারবার কাতরাতে কাতরাতে বলেছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। অফিসারটি তবু ছিল নির্বিকার। সকল পথচারী চিৎকার করে আবেদন করছিল তাকে শ্বাস নিতে দেয়ার জন্য। কেউ তাকে ছেড়ে দিতে বলেনি। সে অবস্থায় তার পালিয়ে যাবার সম্ভনাও ছিল না । ঘাড়ে বসার মত এই অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কি খুব প্রয়োজন ছিল?

৩. Sensitive and Susceptible : সংবেদনহীনতা বা চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে নির্লিপ্ততা দায়িত্বকে অকারণ জটিল করে তুলে। এ আচরণ যুদ্ধক্ষেত্রে চলে, সিভিল অর্ডার ম্যানেজমেন্টে নয়। একজন সাদা ধবধবে সশস্ত্র ক্ষমতাধর মানুষ একজন কালো বন্দী অসহায় মানুষকে রাজপথে ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে, কালো মানুষটি বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। এ দৃশ্য বিবেকমান মানুষকে বিব্রত করবেই , উদ্দেশ্য যতই সৎ হোক, যতই আইনানুগ হোক । সাদাকালো, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর গোপন বৈরীতায় ভরপুর সমাজে সে সত্যটি অনুধাবন দরকার। বল প্রয়োগের ব্যাপ্তি কতটুকু হবে , জনসমর্থন পক্ষে রেখে তা বাস্তবায়নে সর্বোত্তম উপায় কোনটি তা নিয়ে মাঠ পুলিশের স্বচ্ছ ভাবনা থাকা জরুরী ।

৪. Knowledge is Power : কোবিড ১৯ এর ঝড়ে ৬০ মিলিয়ন আমেরিকান নাগরিকের চাকরি গেছে যার আনুপাতিক হার কৃষ্ণবর্বের লোকদের মধ্যে লক্ষনীয়ভাবে বেশী। চলমান মহামারীর থাবাও নাজেহাল করেছে কালোদের বেশী। দারিদ্রের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাওয়া কালোরা বরাবরই সাদা প্রতিবেশীদের তুলনায় অকর্ষিত থেকে গেছে। আদিকালের সেই দাসত্বের পথ ধরে চলে আসা হালের লুক্কায়িত বর্ণবাদ, তার সৃষ্ট কালো মানুষের মনস্তত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই। বঞ্চনায় কালোদের হঠাত ফুঁসে উঠার ইতিহাস আছে। মনুষ্যজাতি আজ এক মহাসংকটে, বদলে গেছে তার চেনা চেহেরা। এরও খবর রাখা চাই। পরিবর্তন বিবেচনায় না নিয়ে তোতাপাখির মত শেখা বিদ্যার সবক্ষেত্রে সমপ্রয়োগ পুলিশের কাজকে জটিল করে তুলে। জ্ঞানের সমর্থন শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমায়।

৫. Make the Abusive Responsible : পুলিশকে কাজ করতে হয় টিমে। টিম স্পিরিট কাজের অন্যতম শক্তি। টিমে কাজ করার কিছু সমস্যাও আছে। কোন একজন সদস্য ভুল করলে তার দায় বর্তায় পুরো টিমের। তাই কেউ একজন ভুল বা অন্যায় করলে টিমের অন্যরা এগিয়ে এসে তা শোধরানো প্রয়োজন পড়ে। এই ঘটনায় টিমের কোন সদস্যই অভিযুক্ত অফিসারকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি, এখন দায় নিতে হচ্ছে পুরো পুলিশকেই। বিষফোঁড়া কেটে ফেলা মানে মাথা কেটে ফেলা নয়। তার প্রয়োজন আছে।

৬. Eyes on Police : মেইনস্ট্রিম মিডিয়া নয় এখন সোশ্যাল মিডিয়াই বেশী শক্তিশালী। আশেপাশের অসংখ্য পথচারীই এখন সংবাদদাতা।ঈগল চোখের সামনে কেবল চিরচেনা শেখানো উপায়ে নয়, কৌশলী হয়েই উদ্দেশ্যসাধন করতে হয়। ‘সব ভাল যার শেষ ভাল ‘ পুলিশের ক্ষেত্রে প্রায়শ সে আপ্তবাক্য প্রযোজ্য নয়৷ শক্তি প্রয়োগ এন্ড রেজাল্ট আনার একটা ধাপ, পুলিশের মূল ভূমিকা কেবল তাতেই সীমাবদ্ধ। তার কাজের বিশ্লেষণের জন্য শেষ ফল আসার অপেক্ষায় কেউ বসে থাকে না।

৭. Reform : সমাজ মনস্তত্ব, প্রয়োজন, নিরীক্ষা আর গবেষণার আলোকে পুলিশীকাজের ধরণে সময় সময় পরিবর্তন আনা জরুরী। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তার প্রয়োজন একটু বেশীই। অস্ত্র, আইন আর স্বাধীন বিবেচনান্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা যে সংগঠনকে দেয়া আছে জনস্বার্থে তার সময় সময় রিভিশন একান্ত প্রয়োজন নইলে মাত্রা অতিক্রমের শংকা প্রবল হয়।

মনে রাখা দরকার পুঁজির গোলকায়ন হয়, মানুষের হয় না। আপনার পুঁজি থাকলে আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়া আপনাকে তার দেশে নিয়ে গিয়ে জামাই আদর করবে, সেটি যদি না থাকে ভূমধ্যসাগরর তীরে গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকতে হতে পারে, কেউ দায় নিবে না। ধনবাদী বিশ্বের মূল মধুটা পুঁজিতে। এক দেশের নাগরিক হলেও কিছু যায় আসে না, সামর্থ্য না থাকলে কেউ টেনে নেয় না কাছে। প্রতিবেশীও চোখ ফিরিয়ে চলে যায়। পৃথিবীকে উত্তাল হওয়া থেকে রক্ষার জন্য, মানুষের সমমর্যাদা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপরিচালনায় পরিবর্তন আনার কথা পশ্চিমা বিশ্বকে এবার হয়ত ভাবতে হবে। সমান সুযোগই শুধু নয়, যিনি খর্ব তাকে একটু বেশী সুবিধা দিয়েই উপরে তুলতে হবে, নইলে বিশ্বায়নের সুফল সব দোরগোড়ায় পৌঁছবে না, সকলের শান্তিও সংহত হবে না।

পুলিশ হল বিয়েবাড়ির ভিড়ে সেজেগুজে যাওয়া সুন্দরী হালফ্যাশনের তরুণী মায়ের কোলে ক্রন্দনরত সন্তানের মত। সবাই বিরক্তিভরে তাকাচ্ছে। নিজের সন্তান, ফেলাও যাচ্ছে না, আবার কান্নাও থামানো যাচ্ছে না। সন্তানের দাবি মেটানো ছাড়া এই অস্বস্থি থেকে বেরুনোর সহজ কোন উপায় নেই মায়ের। সাদা পশ্চিমে সংখ্যালঘু কালোরা আজ সে বিরক্তিকর কান্নায় ঘোরে আছে৷ ‘কালো জীবনেরও দাম আছে’ এই শ্লোগানের আড়ালে কালো সাদার বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য মোকাবেলাই হয়ে উঠেছে মূল দাবী। সুযোগহীনতা-শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া-দারিদ্র- স্বাস্থ্যহীনতা- আইন অমান্য- সুযোগে ফুঁসে উঠা এই দুষ্টচক্রেই আটকে আছে কালো মানুষ৷ নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেশী সাদা মানুষের এখন সেদিকে আলো ফেলা দরকার৷ নইলে কালো মানুষের কান্না থামবে বলে মনে হয় না৷