করোনায় মৃতের দাফন নিয়ে ইউএনও’র আবেগঘন স্ট্যাটাস
করোনাভাইরাসের সংকটকালীন সময়ে নিজের জীবনের দিকে না তাকিয়ে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তারা। এই কাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ ভাইরাসে সংক্রমিতও হয়েছেন। তবুও মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। এই কাজগুলো করতে গিয়ে কিছু বাস্তবিক অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাদের। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানবিকতার বিভিন্ন রূপ। করোনায় মৃতের আত্মীয়-স্বজন কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এমনই একটি ঘটনার কথা নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগঘন একটি স্ট্যাটাস দিয়ে।
নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়া মারীয়া। গত ২ জুন দুপুর বারটায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের পানিহারা গ্রামের বন কর্মকর্তা শফিউর রহমান। মৃতের লাশ দাফন করতে গিয়ে স্বজনদের ব্যাপারে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন
জয়া মারীয়া। সেই অভিজ্ঞতাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন তিনি।
পাঠকের জন্য নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহীর আবেগনঘন স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হল-
করোনা শিখাবে অনেক কিছু….
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বন কর্মকর্তা জনাব শফিউর রহমানকে নিয়ামতপুরের রসুলপুর ইউনিয়নের পানিহারা গ্রামে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আজ ০২/০৬/২০ তারিখ দুপুর বারটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে জানাজার নামাজ শেষে রাত ৯টায় তাকে দাফন করা হয়। দাফন কার্যক্রমে সহায়তা করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
নিয়ামতপুরে আজই প্রথম একজন করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন হলো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন লাশ নিয়ে রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। তারা ৪টি পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক চেয়েছিল। এগুলো কারও মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেও চলতো। কিন্তু নিজে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলাম দাফন কার্যক্রমে স্থানীয়ভাবে কোন বিঘ্ন হতে পারে আশংকা থেকে। এর আগে বিভিন্নভাবে জেনেছি করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফনে স্বজনদের তীব্র অবহেলার কথা।
নিজ আগ্রহ থেকে আমার সাথে যোগ দিয়েছিলেন সহকর্মী বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জিল্লুর রহমান, ওসি সাহেব এবং উপজেলা বন কর্মকর্তা মোঃ শরিফুল।
শুরু থেকেই কত সমস্যা! লাশ বহনের খাটিয়া দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনীহা। কিন্তু আমি যাওয়াতে তো আর না করার উপায় নেই! অতএব ব্যবস্থা হলো।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলনা। কিন্তু ৪ জনে খাটিয়াসহ লাশ বইতে পারছিলেন না। আরেকটু সহযোগিতার দরকার ছিল। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন যিনি পিঠে জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন এবং হাতে টর্চ বহন করছিলেন, তিনি সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু তার পিপিই নেই। অতএব, তাকে অনুমতি দিতে পারছিলাম না!
মৃতের ভাই বিকেল থেকেই পিপিই পরে ঘুরছিলেন। তাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাটিয়া বইতে সহায়তা করার অনুরোধ করলাম। বলামাত্র সেখান থেকে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেলেন! আর এলেননা।
চারপাশে কোন আত্নীয় স্বজন নেই। অন্ধকারে ভুতুরে পরিবেশ! মৃত ব্যক্তির দুটো সন্তান কেঁদেই চলেছে। ওরা কাছেও আসতে পারছেনা। ছটফট করছে।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ৪ জন তখনও লাশের খাটিয়া উঠানোর চেষ্টা করছে। উঠানোর পর এগুতে পারছেনা। আবার নামিয়ে ফেলছে। বেশ ভারী। সদ্য প্রয়াত প্রিয় পিতার এমন অসহায় অবস্হা কোন সম্তান মেনে নিতে পারেনা। বড় সন্তান নাসিম যে এবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে, সে কাতর কন্ঠে অনুরোধ করতে লাগলো সে খাটিয়া ধরতে সাহায্য করবে কিনা? কষ্ট হলেও তাকে ‘না’ বললাম।
আরেকটা পিপিইর ব্যবস্থা হলো। সেটা পরানো হলো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সেই সদস্যকে, যিনি টর্চ এবং জীবানুনাশক স্প্রে বহন করছিলেন।
তারা মিলে খাটিয়া উঠালেন। এবার টর্চ জ্বেলে সামনে পথ দেখানোর জন্য একজনকে খুঁজছিলাম। ডাকাডাকি করলাম। অনুরোধ করলাম। আত্নীয়স্বজন কেউ এলোনা! নিরাপদ দূরত্বে থেকে শুধু একটা টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাবে এর জন্যও কোন স্বজন রাজী হয়না!
যেহেতু জানাজা শেষ, তাই ইমাম সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তাকেই বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে লাশবহনকারীদের সহায়তা করার জন্য। তিনি অনুরোধ রাখলেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য আর ইমাম সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতায় অবশেষে দাফন সম্পন্ন হলো।
দাফন কার্যক্রমে আত্নীয়-স্বজনদের এমন আচরণ দেখে মৃতের স্ত্রী আর সন্তানদুটো কতটা কষ্ট পেয়েছে অনুমান করতে আমার বুক কাঁপছে! ওরা ভাইবোন একে অন্যকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল! নাসিম চিৎকার করে লাশবহনকারীদের বলছিল “ভাই ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন, তবু আব্বু যেন পরে না যায়!”
আমি, আমার সহকর্মী জিল্লুর, ওসি সাহেব আর উপজেলা বন কর্মকর্তা পুরো দৃশ্য দেখে কেমন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম!
করোনা যে কত কি শিখাবে কে জানে?
ফেরার পথে যখন দেখি রাত ৯:৩০ মিনিটেও সদরের হিন্দু পাড়ার মোড়ে ৪ জনে ব্যাপক ক্যারাম খেলছে… মেজাজটা আর ঠিক রাখতে পারলাম না! এই আমাদের করোনার ভয়? করোনাকে কোন ভয় নেই, কোন নিয়ম কেউ মানবেনা… আবার করোনায় মারা গেলে তার প্রতি এত অবহেলা?
৪ জনকেই পুলিশের জিপে তুলে দিলাম। সাথে প্রিয় ক্যারামখানাও! অভিভাবকরা ঘরে বসে প্রিয় সন্তানের খোঁজ রাখতে পারেনি, এখন থানায় এসে খোঁজ নিক!
রাত ২টা পেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, যেন এখনও কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আজ থেকে প্রায় ৪ বছর আগে আমিও বাবার জন্য এভাবে কেঁদেছিলাম। তবে পার্থক্যটা হলো আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো জরিয়ে ধরে কাঁদতে পেরেছিলাম…. কিন্তু ভাগ্যহত নাসিম আর তার ছোটবোন তা পারেনি!
শফিউর সাহেবের বিদেহী আত্মা জান্নাতবাসী হোক। আল্লাহ শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এ শোক সইবার শক্তি দিক। আমিন।
(সংগ্রহে: মোঃ নাসির, বিশেষ প্রতিনিধি।)