জীবনের কথা, পর্ব-৮
বৃটেনে বাঙালী এমপি হওয়ার পূর্বের কাহিনী
:: মোঃ রহমত আলী ::
২০১০ সালে হাউজ অব কমন্সে ব্রিটিশ বাঙালি এমপির অভিষেক হলেও এর পূর্বে সূযোগ থাকা সত্বেও অন্তত ১৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে। শুধু অপেক্ষা নয়, রীতিমত আন্দোলনে নামতে হয়েছে এক শ্রেনীর কায়েমী স্বার্থবাদিদের বিরুদ্ধে। এসময় একদিকে সাদাদের সুক্ষ কারসাজি অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য এবং সর্বোপরি কোন কোন বাঙালীর মেরুদন্ডহীনতা- এসব কারণেই ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত কোন বাঙালী এমপি হতে পারেননি। তাই এ মেয়াদকালে উড়ে এসে জুড়ে বসে বাঙালির মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়েছে বহিরাগত সূযোগ সন্ধানীরা।
সেই ’৯০ সালের গোড়ার কথা। আমি বিলেতে এসেছি সবেমাত্র। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থা তাই চলার ফাঁকে ফাঁকে লন্ডনের বাংলা পত্রিকার বিভিন্ন অফিসে ঘুরে-ফিরে সময় অতিবাহিত করতাম। জনমত, সুরমা, নতুন দিন ছিল সে সময়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর মধ্যে আমি সুরমা অফিসেই বেশী যাতায়াত করতাম, যেখানে আমি পরবর্তীতে কাজ করার সূযোগ পেয়েছিলাম। নজরুল ইসলাম বাসন ভাই ছিলেন তখন এ পত্রিকায় সম্পাদক। তিনি প্রায় সময়ই একজন বাঙালী বংশোদ্ভুত এমপির কথা আলাপ করতেন। বলতেন, আমাদের কমিউনিটির এ স্বপ্ন কবে পুরণ হবে? আমি তাঁর মধ্যে তখন একটা আফসোসের ভাব লক্ষ্য করতাম।
এহেন অবস্থায় হঠাৎ একদিন আমি সুরমা পত্রিকায় আমার নামে চিটিপত্র কলামে ” বাঙালি এমপি এখনই নয় কেন ” শিরোনামে একটি লেখা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যাই। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম যে, হয়তো আমার নামে নাম অন্য কেউ এ লেখাটি পত্রিকায় দিয়েছে। কিন্তুু সুরমা অফিসে গিয়ে আমার সেই ধারণা পাল্টে যায়। আমি তখন বুঝতে পারি যে, লেখাটি আমার না হলেও আমার নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সেটা হয়েছে তখনকার সময়ের বাঙালি কমিউনিটির প্রবীণ এক নেতার কারণে। তিনি শুধু কমিউনিটি নেতা ছিলেন না। সাথে সাথে ছিলেন একটি বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের একজন। তাই তখন যারা এখানে পত্রিকা চালাতেন তারা নানা কারণে তাঁকে সম্মান করতেন, সমীহ করতেন। পারত পক্ষে তাঁর ধ্যান, ধারণা বা মতের বিরুদ্ধে কোন কিছু লিখে বিরাগভাজন হতে চাইতেন না।
বস্তুত সে সময় বাঙালি কমিউনিটি থেকে যে একজন এমপি নির্বাচিত হতে পারতেন সে কথা সেই নেতার চিন্তার বাইরে ছিল। এ প্রসঙ্গ এলেই নাকি তিনি অনেকটা উষ্মা প্রকাশ করে বলতেন, এখনও বাঙালিরা এমপি হওয়ার মত পরিপক্ষতা অর্জন করেনি। তাই আরো অপেক্ষা করতে হবে। এ জন্যই এ ব্যাপারে লেখার দৃষ্টতা প্রদর্শন কেউ তখন করেননি। আর তাই এ লেখার শিরোনামের তীর ছিল তাঁর দিকে লক্ষ্য করেই। অর্থাৎ ‘বাঙালী এমপি এখনই নয় কেন’? সে যাই হোক, ভাগ্য ভালো আমাকে তখনও তিনি চিনতেন না। পরে জানলাম লেখা দেখে তিনি সরাসরি সুরমা অফিসে এসে বিরক্তি প্রকাশ করে গেছেন। এর পরবর্তীতে আমি তাঁকে দেখলে তফাৎ বজায় রেখে চলতাম।
তবে এর পর থেকেই মূলত স্থানীয় বাংলা পত্র-পত্রিকাগুলো এ-বিষয়ে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সংবাদ প্রেরণ করতে থাকে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সমস্ত বিষয়ের শিরোনাম ছিল, ‘বাঙালি এমপি চাই’ ‘প্রথম বাঙালি এমপি কে হবেন’, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন বাঙালি এমপি নির্চানের উজ্জ্বল সম্ভাবনা’, ‘পিটার শো’র বিদায়ে বাঙালি এমপি হওয়ার পথ সুগম হলো’ প্রভৃতি। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাগুলোতে এ-ব্যাপারে হতাশার সুরও পরিলক্ষিত হতে থাকে। যেমন, আমরা কি একজন বাঙালি এমপি পাবো? ‘বাঙালি এমপি লড়াই কি পার্লামেন্টে যাওয়ার পূর্বেই শেষ হয়ে যাবে? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
১৯৯৫ সালের ২০ মে শনিবার তৎকালীন স্টেপনি ও বেথনাল গ্রীণ (বর্তমান বেথনালগ্রীন ও বো) এলাকার লেবার দলীয় প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান রাইট অনারেবল পিটার শোর এমপি তার ৩১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অবসরগ্রহণের কথা ৭১তম জন্মদিনে ঘোষণা করার পরপরই সে পার্টি থেকে এমপি নির্বাচনে বাঙালীদের মধ্যে তৎপরতা শুরু হয়। আর এ আসনটি যেহেতু ছিল দীর্ঘদিন থেকে ছিল লেবার পার্টির অধিনে তাই সবাই কেবলমাত্র এখান থেকেই যিনি নমিনেশন পাবেন তাকেই সম্ভাব্য এমপি হিসাবে ধরে নিতেন।
যে সমস্ত প্রার্থী সে সময়ে এ দলের মনোনয়ন লাভের দৌঁড়ে তৎপর ছিলেন, তাদের মধ্যে কাউন্সিলর গোলাম মর্তুজা, কাউন্সিলর রাজন উদ্দিন জালাল, কাউন্সিলর পলা মঞ্জিলা উদ্দিন (বর্তমানে ব্যারেনস), খান আহমদ নওয়াজিস কুমার মুর্শিদ, কাউন্সিলর আব্দুল আসাদ, জাহাঙ্গির আলম জান ও দেলোয়ার হোসেন অন্যতম। তাঁরা প্রায় দু’বছর এ জন্যে নানা তৎপরতা চালিয়েছিলেন বিভিন্ন নাটকীয়তার বিরুদ্ধে। আর এ নাটকীয়তা চলে একশ্রেণীর বর্ণবাদীদের হীন রাজনৈতিক কারণে।
১৯৯৭ সালের ১ মে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ আসনে তখন লেবার দলের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য প্রায় ৭০০ ইলিজিবল মেম্বার ছিলেন। যাদের মধ্যে বাঙালি সদস্যের সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশত। আর তাদের মাধ্যমেই এ আসনে একজন প্রার্থী বাছাই করার জন্য লেবার পার্টির জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় কমিটিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালানো হয়। তখন বাঙালি প্রার্থীদের মত সাদা প্রার্থীরাও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন, উনা কিং, ক্লদ মরিচ ও সাম এভারিংটন প্রমূখ।
প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় প্রথমে একটি লং লিস্ট বা প্রাথমিক তালিকা তৈরী করা হয়। এতে সম্ভাব্য বাঙালিরা স্থানলাভ করলেও শর্ট লিস্ট বা সংক্ষিপ্ত তালিকায় অনেকেই বাদ পড়ে যান। তখন সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিলেন বাঙালীর দাবি আদায়ের বলিষ্ট কন্ঠস্বর রাজন উদ্দিন জালাল। কিন্তু তিনিও বাদ পড়ে যান। সে তালিকায় কেবল মাত্র পলা মঞ্জিলা উদ্দিন স্থান লাভ করেন।
এরপর অনেক নাটকীয়তার পর নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে লেবার পার্টি তাদের প্রার্থী ঘোষনা করে স্থানীয় পার্টি মেম্বারদের এক সিলেকশনের মাধ্যমে। এতে সাম এভারিংটন পান সর্বোচ্চ ভোট, দ্বিতীয় হন উনা কিং, তৃতীয় হন পলা উদ্দিন এবং তৃতীয় হন ক্লদ মরিচ। কিন্তু প্রার্থী নির্বাচনের নিয়মানুযায়ি সাম এভারিংটন প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় পছন্দে উনা কিং পার্টির নমিনেশন পেয়ে যান। বাঙালীরা তখন লেবার পার্টির সিদ্ধান্তে আশাহত হলো।
এদিকে, এ আসনে তখন ক্ষমতাসীন দল কনজারবেটিভ পার্টি এ আসনে একজন বাঙালী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। লেবার পার্টির প্রার্থী নির্বাচনের অনেক আগেই তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারী মাসে একজন বাঙালী প্রার্থী ডঃ কবির চৌধুরী এ মনোনয়ন লাভ করেন। আর তিনিই ছিলেন বৃটেনের কোন পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথম বাঙালী প্রার্থী। সাথে সাথে লিবারেল ডেমোক্রেট থেকেও আরেকজন বাঙালী প্রার্থী সৈয়দ নূরুল ইসলাম এ আসনে নমিনেশন পান।
এ নির্বাচনের ফলাফল ছিল, লেবার পার্টির উনা কিং ২০৬৯৭, কনজারভেটিব পার্টির ডঃ কবির চৌধুরী ৯৪১২, লিবারেল ডেমোক্রেটের সৈয়দ নুরুল ইসলাম ৫৩৬১, হোয়াইটস ন্যাশন্যালিস্ট পার্টির ডেভিট মাইকেল কিং ৩৩৫০, সতন্ত্র মোঃ আব্দুল্লা ৫৫৭ ও সোস্যাল ডেমোক্রেট এর আব্দুল হামিদ ৪১৩।
এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে তেমন কোন জোরদার বাঙালী প্রার্থী লেবার পার্টি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তাই সে মেয়াদেও উনা কিং সিটিং এমপি হিসাবেই এ আসনে পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন। অবশ্য এ সময় কনজাবেটিভ পার্টি থেকে একজন অভিজ্ঞ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অভিজ্ঞ সেই প্রার্থীর নাম শাহগীর ভক্ত ফারুক।
তবে ২০০৫ সালের নির্বাচনে এক আচমকা ঝড়ে উনা কিং এর সাজানো সংসার ভেঙ্গে গেলেও বাঙালীদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। উড়ে এসে জুড়ে বসে এমপি হয়ে যান জর্জ গ্যালওয়ে। এর পর আসে ২০১০ সালের সেই বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচন। তখন লেবার পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে যারা প্রভাবশালী ছিলেন তাদের মদ্যে কাউন্সিলর হেলাল আব্বাস, কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান ও রুশনারা আলী ছিলেন অন্যতম। তাই সবাই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তখন আর বাঙালী এমপি হাতছাড়া হবে না। ফলে হয়েছেও তাই। রুশনারা আলী হলেন, সে সৌভাগ্যের প্রতিক আর বাঙালীরা হলো ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি পাঠিয়ে গৌরবের অধিকারী। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com