জীবনের কথা, পর্ব-১২
লন্ডনে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা ও দিপু মনির বক্তৃতা
:: মোঃ রহমত আলী ::
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তাঁর চিকিৎসার উদ্ধেশ্যে একবার লন্ডনে আসেন। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ এখানে অবস্থান করেন। এ সময় লন্ডনের বুপা ক্রমওয়েল হাসপাতালে তাঁর মেডিকেল চেকআপ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা হয়। এর মধ্যে তাঁর শারিরীক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটন হলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেওয়া এক সংবর্ধনা সভায় যোগদান করেন। দিন ছিল শনিবার। তারিখ ২৬ জুন, ২০১০।
সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংবর্ধনা সভায় বিশেষ করে সাংবাদিক ও দলীয় প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, লর্ড সভার সদস্য বেরোনেস পলাউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর ছোটবোন শেখ রেহানা ও রাষ্ট্রপতির পুত্র সাংসদ নাজমুল হাসান পাপন প্রমুখ। এ অনুষ্ঠানে দর্পণ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে আমি ও মিল্টন কিংস আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এলাইছ মিয়া মতিন আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে অন্যান্যের সাথে সভায় যোগদান করি।
এ সভায় সাবেক এ রাষ্ট্রপতি একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করার আহবান জানান। সাথে সাথে আরো উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। (তবে প্রায় দশ বছর আগে সাবেক এ রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যৎ বানীটি আগামী বছরে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার ক্ষেত্রে কেমন অগ্রগতি লাভ করেছে তা সম্পর্কে সকলেই অবগত)।
এ অনুষ্ঠানে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রি হিসাবে ডা. দিপু মনি বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি যেন বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। তাঁর কথাগুলিকে গুঁচিয়ে আনার চেষ্ঠা করেও যেন তা অগোচালো থেকে যাচ্ছিল। বার বার একই কথার যেন পুনরাবৃত্তি করছিলেন। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্বোধন করা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এ অবস্থা চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও স্বীকার করেন যে, সে দিনের বক্তৃতা তাঁর মনমত হয়নি। কিন্তু কেন এমনটি হলো?
তিনিতো সব সময় অত্যন্ত সুন্দর, সাবলিল ও গোঁচালো বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রধিনিত্বমূলক রাজনীতি ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণের ব্যাপারে একজন একনিষ্ট প্রবক্তা। বিবার্তা নামক একটি সংগঠন ভাল বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাঁকে ‘রাজনীতি’ ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদকে ভূঁষিত করে। তাই তাঁর এ পরিণতি তখন অনেককে পীড়া দিয়েছিল। কেউ কেউ বলাবলি করছিলেন “পররাষ্ট্রমন্ত্রি দিপুমনি’র কেন এমন অবস্থা হলো। আমার মধ্যেও এ প্রশ্নটি তখন জেগেছিল। কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি।
দিপুমনি শুধু সুবক্তা নন একজন স্পষ্টবাদি বক্তাও। প্রথমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই দীপু মনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পুরুতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীদের দেখতে আমরা এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। নারী বা পুরুষ যেই হোন না কেন, দায়িত্ব সকলের কাছেই সমান। দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জ সবার বেলায়ই রয়েছে। তাই এখন দিন বদলের সময়ে নারীপুরুষ হিসেবে নয়, যোগ্যতা ও মেধা দায়িত্ব পালনের প্রধান মাপকাঠি হওয়া উচিত’।
তাঁর সাথে আমিও সুর মিলিয়ে বলতে চাই যে, শুধু দেশে প্রধান মন্ত্রি, বিরোধি দলীয় নেত্রী, স্পীকার বা অন্যান্য নারী মন্ত্রী নন। যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ বাঙালীদের মধ্যে হাউজ অব লর্ডস এবং হাউজ অব কমন্সে যে সমস্ত ব্রিটিশ বাঙালী নির্বাচিত হয়েছেন তারাও সবাই নারী। এরা হচ্ছেন, ব্যারোন্যাস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন, এমপি রুশনারা আলী, এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, এমপি রুপা হক ও এমপি আপসানা বেগম। তা ছাড়া যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভ‚ত একজন হাইকোর্টের বিচারপতি সপ্নারা খাতুন ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম হিজাব পরা একজন বিচারক রাফিয়া আরশাদ দায়িত্ব পালন করছেন। এ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনেল এর সাবেক মহাসচিব আইরিন খানও ছিলেন একজন নারী মানবাধিকার নেত্রী।
সে যাই হউক, দিপু মনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর কিছুটা বিরতি শেষে ৬ জানুয়ারী ২০১৯ তিনি পুনরায় শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন কমনওয়লেথ মিনিস্ট্রেরিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ-এর প্রথম নারী এবং দক্ষিণ এশীয় চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমুদ্র জয় করে।
তাঁর সময়ে বাংলাদেশ সফর করেছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, জার্মান প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান ভুলফ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকসহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ও ক্ষমতাধর নেতৃত্ব। এসব হাই প্রোফাইল সফর দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির সাফল্যকেই নির্দেশ করে বলে অনেকেই মনে করেন।
পররাষ্ট্রন্ত্রী হিসেবে যোগদানের আগ পর্যন্ত ডা. দীপু মনি মানবাধিকার, নারী অধিকার, স্বাস্থ্য আইন, স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য অর্থায়ন, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং পররাষ্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কাজ করছিলেন।
বর্তমানে ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। দশম জাতীয় সংসদে তিনি চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর- হাইমচর) এর প্রতিনিধিত্ব করছেন। সামাজিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য তিনি মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৬ সালের অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি পুনরায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দীপু মনি একাধারে লেখালেখি, শিক্ষকতা, পরামর্শদাতা, গবেষণা, অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি পরিচালনা করেন এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদল নিয়ে গঠিত ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকের মাধ্যমে দুঃস্থ ও স্বাস্থ্যসুবিধা বঞ্চিত মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার কাজ করেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আইন প্রণয়নে জনমত গড়ে তোলার কাজেও নিয়োজিত।
দীপু মনি বাংলাদেশ ছাত্র লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদের কন্যা এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাবেক এ্যাডভোকেট তৌফীক নাওয়াজ দীপু মনির স্বামী। তিনি দেশে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জন করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমঝোতা ও দ্বন্ধ নিরসন এর ওপর একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন । তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবীও বটে ।
এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর-ভৈরব আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ববাধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে ওই বছরের ১৬ জুলাই রাতে আওযামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হন। তখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন জিল্লুর রহমান। দীর্ঘ ১১ মাস শেখ হাসিনার জেল জীবন এবং চিকিৎসার জন্য আরও প্রায় ছয় মাস দেশের বাইরে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের ভারপপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ষষ্ঠবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। তখন প্রথমে সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তার আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান তাঁর সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী আইভি রহমানকে হারান।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. জিল্লুর রহমান মারা যান। এর আগে একই বছরের ৯ মার্চ অসুস্থ হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। ১১ মার্চ সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com