জীবনের কথা, পর্ব-১৩
হিটলারের সাথে এ মূর্তির মানুষটির সম্পর্কের কথা আমার জানা ছিল না
:: মোঃ রহমত আলী ::
আমি যে মুর্তিটির পাঁশে দাঁড়িয়ে আছি সেটা একজন ইংরেজ খ্যাতিমান ব্যক্তি রবার্ট বাডেন পাওয়েলের। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক এবং তাঁর সর্বশেষ পদমর্যদা ছিল ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল। আর সেখানে থাকা অবস্থায় ১৯০৮ সাল থেকে স্কাউটিং দক্ষতা অর্জন করায় অন্যান্য সৈন্যদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। পরবর্তীতে তিনি স্কাউটে নিজের জীবন উৎসর্গ করার লক্ষ্যে ১৯১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তরুণদের স্কাউটিংয়ে উদ্বুদ্ধ করার মানসে পৃথিবীব্যাপি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন। এতে তিনি দারুন সফলতা অর্জন করেন। স্কাউটদেরকে ব্যাডেন পাওয়েলের নির্দেশিত নিয়মানুসারে অনুশীলন, প্রতিজ্ঞাপাঠ ও দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে স্কাউটের সদস্য হতে হয়। তাই তাঁকে স্কাউট আন্দোলনের পুরোধা বলা হয়ে থাকে। তিনি এ জন্য সম্মানসূচক লর্ড উপাধিও লাভ করে থাকেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি লন্ডনে এবং মৃত্যু হয়েছিল ৮৩ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে।
বাডেন পাওয়েলের গড়ে তোলা স্কাউট বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি স্কাউট ও গাইড বিভিন্ন স্কাউটিং সমিতির প্রতিনিধিত্ব করছে এবং এটিতে বর্তমানে ৫৪ মিলিয়ন সদস্য রয়েছে। ২০০৭ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, তিনি বিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাজ্যের ১৩তম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাডেন পাওয়েলের এ মূর্তিটি লন্ডনের বিখ্যাত মাদাম তুসো জাদুঘরেও আছে। এ যাদুঘরটি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের মোম দিয়ে তৈরী মূর্তির সংগ্রহশালা। মাদাম ম্যারি তুসো নামীয় এক ফরাসী মহিলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ সংগ্রহশালাই পরবর্তীকালে ‘মাদাম তুসো’ জাদুঘর নামে পরিচিতি লাভ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এ জাদুঘরের শাখা রয়েছে। লন্ডনের পর্যটনশিল্প ও অর্থনীতিতে মাদাম তুসো জাদুঘর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধুমাত্র মোম দিয়ে গঠিত জাদুঘরটিতে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, তারকা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খ্যাতনামা খুনী ব্যক্তিদের মূর্তিও রয়েছে।
কিন্তু এতকিছুর পর বর্তমানে বাডেন পাওয়েলের মূর্তিটি যুক্তরাজ্যে হুমকী ও বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছে। হয়তো যে কোন সময় তা ভেঙ্গে ফেলা হতে পারে। আর এর প্রেক্ষিতে তা রক্ষার জন্য ২৪ ঘন্টা পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এর কারণটি বর্ননার আগে স্কাউটিং সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। স্কাউটিং হলো বিশ্বব্যাপী এমন একটি সংস্থা যা শিশু, কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক গুণাবলী উন্নয়নের মাধ্যমে তাদেরকে পরিবার, সমাজ দেশ তথা বিশ্বের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। এর কিছু লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, হাতে-কলমে কাজ শেখার মাধ্যমে ছোট-দল পদ্ধতিতে কাজ করা; ব্যাজ পদ্ধতির মাধ্যমে কাজের স্বীকৃতি প্রদানসহ মুক্তাঙ্গনে কাজ সম্পাদন, তিন আঙগুলে সালাম ও ডান হাত করমর্দন, স্কাউট পোশাক, স্কার্ফ ও ব্যাজ পরিধান এবং সর্বোপরি স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞা মেনে চলা প্রভৃতি। সাথে সাথে সদা প্রস্তুত এবং রোভার- সেবাদান ইত্যাদি।
সে যাই হউক, গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেফতার করতে গিয়ে চরম নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক এ বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব। বিক্ষোভে এখনও জ্বলছে আমেরিকা। বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নেওয়া এই বিক্ষোভ থেকে রেহাই পাচ্ছে না বৃটেনও।
বিক্ষোভের জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল শহরে এরকমই এক বিক্ষোভের সময় প্রতিবাদকারীরা সেই শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত সপ্তদশ শতাব্দীর বিতর্কিত ক্রীতদাস ব্যবসায়ি এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি টেনে নামিয়ে তা নদীতে ফেলে দিয়েছে। এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার জন্য অনেক দিন ধরেই ব্রিস্টলের বহু লোক দাবি জানাচ্ছিলেন, কিন্তু এতদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি তা।
এ ঘটনাটি যুক্তরাজ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্ট করেছে, অনেকে দাবি তুলছেন, ব্রিটেনে নানা জায়গায় বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো অনেকের যেসব ভাস্কর্য আছে, সেগুলোও অপসারণ করতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ ইংল্যান্ড স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট বাডেন পাওয়েলের (বিপি) একটি মূর্তি সরিয়ে ফেলল যুক্তরাজ্য। পাওয়েলের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সমালোচকরা বলছেন, তিনি বর্ণবাদী মতামত রাখতেন এবং তিনি অ্যাডলফ হিটলার এবং ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় দায়িত্বশীল এক নেতার মতে স্কাউটস তৈরির জন্য খ্যাতি পাওয়ায় আমরা রবার্ট বাডেন পাওয়েল-এর জীবনের কিছু দিক ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। আর সেগুলোকে তেমন গুরুত্বও দেওয়া হয়নি।
তবে এখানে যে ছবিটির সাথে আমাকে দেখা যাচ্ছে সেটি সেন্ট্রাল লন্ডনের সাউথ ক্যানজিংটন এলাকায়। এখানে কুইন্স গেটে একটি বড় হল রয়েছে। যার সামনে রয়েছে এ মূর্তিটি। আমি এ রাস্থা দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছি। প্রায় সময়ই এটা আমার নজরে পড়ে। আর তাই সময় পেলে ছবি তোলার চেষ্ঠা করি। আমার ছবি তোলার একমাত্র কারণ বিশ^স্কাউট গঠন করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের বিষয়টি। আমি সরাসরি কোন সময় স্কাউটিং এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না তবে আমি তাঁর কথা বইপত্রে পড়েছি, ছবিও দেখেছি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭৮ সালে দেশে থাকাকালীন আমাদের সিলেট জেলার বিশ^নাথ রামসুন্দর হাইস্কুলে তখন স্কাউট দল গঠন করা হয়েছিল। আর সে স্কাউট আন্দোলনের নায়ক ছিলেন এ স্কুলেরই আমার এক সহকর্মী শামসুল ইসলাম ভঁ‚ইয়া। তাঁর নেতৃত্বে এখানে বিভিন্ন সময় স্কাউট সমাবেশ হয়েছে। এর পাশাপাশি এ এলাকার ছেলেরা বিভিন্ন সময় জেলা, বিভাগ এমন কি জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন স্কাউট জাম্বুরী, কাব জাম্বুরীসহ বিভিন্ন সমাবেশে যোগদান করে কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। তা ছাড়া ১৯৯৯ সালে বিশ^নাথ কলেজ মাঠে প্রথম জেলা কাব ক্যাম্পুরি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পরিশেষে আমি যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, যখন এ মূর্তিটির সাথে ছবি তুলি তখন যে উৎসাহ অনুপ্রেরণা ছিল, এখন নিশ্চই সেটা আর থাকার কথা নয়। আর এর কারণ বিশ্লেষন করে বলার প্রয়োজনও নেই। আমি প্রথমে যখন ছবি তুলি তখন যদি জানতাম যে, তিনি হিটলারের একজন আদর্শ অনুসারী তবে হয়তো বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করতাম। তাই এখন সে মূর্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর ফিরেও তাকাতে মন চাইবে না। তাই আমি যখন সে মূর্তির কাছ দিয়ে যাব তখন হয়তো মূর্তিটির এমন ভাব হবে যা একটি গানের ভাষায় বর্ননা করতে চাই, তা হলো-
আগে তোমার যে ভাব ছিলরে বন্ধু
এখন তো আর দেখি না।
আমারে কান্দাইবার মনে বাসনা।
আর আমি তখন উত্তর দেব-
হিটলারের সাথে তোমার যে পিরিতি ছিলরে বন্ধু
সেটাতো জানা ছিল না। তাইতো তোমায় করেছি বন্দনা।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com