সিলেটের শীতল পাটির বিশ্বজয়
সেলিম আউয়াল
দিল্লির সিংহাসনে তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব। সিলেট থেকে তাকে পাঠানো হলো উপঢৌকন এবং সেই উপঢৌকন ছিলো সিলেটের শীতলপাটি। পাঠিয়েছিলেন মুর্শিদকুলী খান। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের চাহিদা ছিলো সব জায়গায়। বিশেষ করে মুগল দরবারে খুব কদর ছিলো এই শীতল পাটির। শীতল পাটির পাশাপাশি সিলেটের বিশেষ ধরনের কাপড়েরও (মুগা তসর) খুব চাহিদা ছিলো। মুসলিম শাসনামলে দিল্লির দরবারে সিলেট থেকে ৩১টি মহালের রাজস্বের (২৮৯৬৪ টাকা) পরিবর্তে এই শীতল পাটি এবং মুগা তসর রফতানী করা হতো। ভৌগলিক আনুকুল্যই সিলেটে এ দুটো শিল্পের বিকাশে সহায়ক হয়েছিলো। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯০২-১৯০৩ সালে সুরমা উপত্যকা (কাছাড় ও সিলেট সন্নিবিষ্ট ছিলো সুরমা উপত্যকায়) হতে প্রায় ১,৪০,০০০ মন পাটি রফতানী হয়েছিলো। শীতল পাটি হচ্ছে মুর্তা নামে এক ধরনের ঝোপ জাতীয় গাছের বেত নামের ছাল দিয়ে তৈরী সামগ্রী। অনেকটা বিছানা চাদরের মতো। তবে পার্থক্য হচ্ছে বিছানা চাদর সুতো দিয়ে তৈরী সামগ্রী আর শীতল পাটি হচ্ছে বেত তৈরী সামগ্রী। শীতল পাটিতে শুয়ে থাকলে একটি শীতল ছোঁয়া পাওয়া যায়। এজন্যে শীতল পাটির সাথে শীতল শব্দটা জড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী হওয়ায় শীতলপাটি স্বাস্থ্যসম্মত।
সিলেট একসময় অপূর্ব চারু ও কারু শিল্প সামগ্রী বিশেষত বাঁশ ও বেতের কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। ঐতিহাসিক অচ্যুতচরণ লিখেছেন, সিলেটের কারিগররা বেত শিল্পে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। শেখঘাটের কারিগরদের বেত দিয়ে বানানো একটি ছোট্ট ঘর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের একটি প্রদর্শণীতে পাঠানো হয়েছিলো। ঘরটি সবার দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিলো এবং পুরস্কারও পেয়েছিলো। সাংবাদিক আবদুল মঈদ চৌধুরী লিখেছেনÑ বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরি গ্রামের একজন শিল্পীর বানানো একটি ফরমায়েশি শীতলপাটি মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে স্থান পেয়েছিলো। এটি সেই সময়ে চারশো টাকায় বিক্রি হয়েছিলো।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট এসেছিলেন। সিলেট সফরকালে সিলেটের বেত ও বাঁশের বানানো চেয়ার টেবিল ও ব্যাগ ইত্যাদি দেখে অভিভূত হয়ে কয়েক ফর্দ কিনে নিয়ে শান্তি নিকেতনে ব্যবহার করেছেন। বাঁশ বেত সামগ্রীর মধ্যে শীতলপাটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। একসময় মুগল বাদশাহদের মন যুগিয়েছিলো। আজো বাংলাদেশে আসা রাজা, রাণী, রাষ্ট্রনায়ক, মেহমান গুণীজনকে অথবা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মাননা জানানো বা উপহার সামগ্রী হিসেবে শীতলপাটির বিকল্প নেই। এই ধারাবাহিকতা আজো আছে।
সিলেটের শীতলপাটির সূক্ষ্মতা এবং উচ্চমান থেকে অনুমান করা হয় এর পেছনে নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো।
দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন,‘শ্রীহট্টে’র ‘পাটিয়ারা দাস’ নামক এক শ্রেণীর লোক বেতের পাটি প্রস্তুত করিয়া থাকে। ইহা উৎকৃষ্ট নৈপূণ্যের পরিচায়ক। জলসুখা, জগন্নাথপুর, জফরগড়, প্রতাপগড়, চাপঘাট প্রভৃতি স্থানে ঐ শিল্প বিশেষ শ্রী সম্পন্ন ছিল। এক একখানি পাটির মূল্য ২০০ টাকা পর্যন্ত হইত। ধুলিজুরার (ইটার অন্তর্গত) শিল্পী যদুরাম দাস ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় কৃষি প্রদর্শণীতে ৯০ টাকা মূল্যের একখানি পাটি দেখাইয়া স্বর্ণ পদক পাইয়াছিলেন।’
শীতলপাটি সিলেটকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করেছে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে রোমে অনুষ্ঠিত হস্তশিল্প প্রদর্শণীতে সিলেট বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনগরের মনিন্দ্র নাথকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। এর আগে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজনগরের প্রবঞ্জয় দাস বিসিক-এর ইবংঃ পৎধভঃংসধহ হধঃরড়হধষ ধধিৎফ লাভ করেন।
শীতল পাটির কাঁচামাল হচ্ছে ‘মুর্তা’ নামের এক ধরনের গাছ। এগুলো বনময় জলাভূমিতে আগাছা হিসেবে জন্মে। সিলেট অঞ্চলের সব জায়গায়ই ‘মুর্তা’ প্রচুর জন্মাতো। বিশেষ করে বালাগঞ্জ ও তার পাশের উপজেলা রাজনগরে প্রচুর পরিমানে জন্মে। মুর্তা গাছটি প্রায় পাঁচ ছ ফুট উচু হয়। গাছটি এক দেড় ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মতো। গাছ কাটার পর গাছের ছাল সংগ্রহ করতে হয়। গাছের এই ছালই হচ্ছে শীতল পাটি তৈরীর উপকরণ। এই ছাল দিয়ে বানানো হয় শীতলপাটি। ছালটা গাছের সাথে জড়ানো অবস্থায় গাঢ় সবুজ রঙ্গের থাকে। গাছ থেকে ছালটা আলাদা করার পর তার রঙ হয় রূপালী। বেতশিল্পীরা কখনো কখনো রূপালী বেতকে নানা রঙে রাঙ্গিয়ে নিতেন। কোন ধরনের যন্ত্র ছাড়া খালি হাতেই এই পাটি বানানো হয়। সাধারণত: একটি পাটি সাত ফুট বা পাঁচ ফুট হয়ে থাকে। একটি শীতলপাটি বানাতে পনের থেকে বিশ দিন, এমন কি পাঁচ থেকে ছ’মাস সময় লাগে। একটি শীতলপাটির দাম পাঁচশ’ টাকা থেকে শুরু করে ছ’ হাজার পর্যন্ত হয়। তবে ফরমায়েশ দিয়ে পছন্দমতো পাটি তৈরী করাতে খরচ আরো বেশী হয়। কিংবদন্তী আছেÑশীতলপাটির শিল্পীরা এতো উন্নত মানের শীতলপাটি বানাতে পারেন, সেই পাটির উপর একটি সাপ ছেড়ে দিলে সেই সাপ শীতলপাটির উপর চলাচল করতে পারে না।
বালাগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রাম, আতাসন, শ্রীনাথপুর, গৌরিপুর, মহিসাষি, চানপুর, লোহামুড়া, কুয়ারগাঁও, কাশীপুর, তিলকচানপুর গ্রামে এখনো শীতলপাটি তৈরী হয়। বালাগঞ্জ ছাড়াও সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, রাজনগরসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার দুশোরও বেশী গ্রামে শীতলপাটি বুননের সাথে কয়েক হাজার পরিবার জড়িয়ে রয়েছে। যুগ যুগ ধরেই বংশ পরম্পরায় এসব গ্রামের নারীপুরুষেরা এই কাজ করছেন। তবে এই শিল্পের সাথে জড়িত ‘পাটিয়ারা দাস’ শ্রেণির মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। পাটি তৈরীকে পেশা হিসেবে নিয়ে জীবন যাপন করা আজ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আজ অনেকে এই পেশা থেকে সরে গেছেন। একটি শীতলপাটি বানাতে প্রচুর সময় লাগে, আর তো রয়েছে পাটি বানানোর উপকরণের মূল্য। এজন্যে পাটি বিক্রি করে এর উৎপাদনকারীরা উপযুক্ত মূল্য পান না। বিপণন একটি বড়ো সমস্যা। এরপরও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে ছোট পরিসরে পাটির বাজার বসে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজারে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার সকাল দশটা থেকে বেলা দু’টা পর্যন্ত জমে উঠে শীতলপাটির বাজার। এই হাটে পাইকারী ও খুচরা দু’ভাবেই পাটি বিক্রি হয়। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার দাসের বাজার এলাকায় প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার শীতলপাটির হাট বসে। এছাড়াও বড়লেখা উপজেলার বাংলাবাজার, হাজিগঞ্জ, দক্ষিণভাগ, শাহবাজপুর, রাজনগর উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলাসহ সিলেটের অন্তত: ত্রিশটি স্থানে শীতলপাটির হাট বসে। বালাগঞ্জ উপজেলায় ‘শীতলপাটি উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা রয়েছে। বালাগঞ্জের উপজেলা সদরে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে উপজেলা সদরের বাসিন্দা হিমাংশু ধর ‘পাটিঘর’ নামে শীতলপাটির একটি দোকান খুলেন। এর পাশাপাশি এখন সেই বাজারে আরো একটি শীতলপাটির দোকান রয়েছে। সিলেট নগরীর বন্দরবাজারও শাহজালাল (র.) মাজার এলাকার বিভিন্ন বেতশিল্পের দোকানে শীতলপাটি বিক্রি হয়।
শীতলপাটি শুধু যে একটি ব্যবহার্য সামগ্রী তা নয়। শিল্পীরা শীতলপাটির জমিনে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তুলেন। গ্রামের নিরক্ষর মহিলা, কিন্তু তাকে ধারনা দিলে তিনি পাটির জমিনে ফুটিয়ে তুলতে পারেন বাংলা, আরবি, ইংরেজি বর্ণমালা। যে মহিলা কোনদিন তাজমহল দেখেননি, স্মৃতিসৌধ দেখেননি, তিনিই বেত দিয়ে ছবি আঁকেন সেই সব স্থাপনার। বাংলাদেশের মানচিত্র, পশুপাখি, নৌকা, মসজিদ, মন্দির ফুটিয়ে তুলেন পাটিতে। বিষয়টি স্পষ্ট থাকা প্রয়োজনÑশীতলপাটির জমিনে রং তুলি দিয়ে এসব ছবি আঁকা হয় না। নানা রংয়ে বেতকে রাঙিয়ে বেত দিয়ে বুননের মাধ্যমে এসব দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়। শীতল পাটির আবেগ ঘন আরেকটি দিক হচ্ছে, একজন নারী দুই আড়াই মাসে একটি শীতল পাটি তৈরী করেন। তিনি কোন ধরনের যন্ত্রের সাহায্য নেন না। দীর্ঘ সময়ে শীতলপাটি তৈরী করতে গিয়ে কতো আনন্দবেদনার স্মৃতি রোমন্থন করেন শিল্পী। বেদনার স্মৃতিতে কতো ফোটা চোখের জল ঝরেছে শীতল পাটির বুকে, কে রেখেছে তার হিসেব। বেতের পরিধির মাপে শীতলপাটির নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন: সিকি, আধুলি, টাকা, নয়নতারা, আসমান তারা ইত্যাদি।
সিলেটের শীতলপাটি নিয়ে আমরা গর্ব করলেও নানা কারনে শীতলপাটির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। শীতলপাটির উৎপাদনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়Ñ১. ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ ভাগের পর পাটি শিল্পের সাথে জড়িত ‘পাটিয়ারা দাস’ নামে পরিচিত কারিগরদের বড়ো একটি অংশ ভারতে চলে যান, ২.যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরমুখী প্রবণতা, ৩. বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে প্লাস্টিকের পাটি তৈরী, ৪. মুর্তা উৎপাদনের উপযোগী বনভূমি ও জলাশয় ধ্বংস ৫. মুর্তা বেতের অভাব ৬. শীতলপাটি শিল্পীদের আর্থিক সংকট, ৭. পাটির বাজারজাতকরণ সমস্যা, ৮. পাটির উৎপাদন খরচ বাড়ায় ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়া।
শীতলপাটি শিল্প বিকাশের পথের বাধা সরাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া দরকার। এগুলো হচ্ছেÑ১. শীতলপাটির সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া, কাজের মানোন্নয়নের জন্যে শিল্পীকে পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে ২. প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে প্লাস্টিক পাটি তৈরী বন্ধ করা ৩. বনভূমি ও জলাশয় রক্ষা করে মুর্তার বাগান সৃষ্টি ৪. পাটির স্থায়ী বাজার সৃষ্টি ৫. মুর্তা উৎপাদনকারী, শীতলপাটির কারিগর, শীতলপাটির বিপণনকারীÑএই তিনটি পক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে, শীতলপাটির ব্রান্ডিংটা খুবই জরুরী ৬. শীতলপাটির বিকাশের জন্যে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। অন্তত: সিলেটের রিসোর্টগুলোতে শীতলপাটি প্রদর্শণী, শো-পিস হিসেবে ব্যবহার করলে এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়বে ৭. বেতশিল্পীদেরকে প্রয়োজনে রিণ সুবিধে দিতে হবে।
সবশেষ খবরÑ নানা প্রতিবন্ধকতার জাল ছিড়ে সিলেটের শীতলপাটি বিশ্ব জয় করেছে। বিশ্ব নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় বাংলাদেশের শীতল পাটিকে যুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর বুধবার বাংলাদেশ সময় দুপুর একটা বত্রিশ মিনিটে এ স্বীকৃতির ঘোষণা দেন ইউনেস্কোতে রিপাবলিক অব কোরিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি লি পাইয়ংগ হাইউন। এর আগে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলার বাউল সঙ্গীত ও ঐতিহ্যবাহী জামদানী বুনন পদ্ধতি ইউনেস্কোর এই তালিকায় যুক্ত হয়। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়Ñ ‘৬ ডিসেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশ সময় ১টা ৩২ মিনিটে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশে^র নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (Intangible Cultural Heritage) প্রতিনিধিত্বশীল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদ (Inter-governmental Committee for the Safeguarding of the Intangible Cultural Heritage)বাংলাদেশ সরকারের শীতলপাটি বিষয়ক প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এতে বাংলাদেশ সরকারের Traditional art of Shital pati weaving of Sylhet of Bangladesh বিধারহম ড়ভ ঝুষযবঃ ড়ভ ইধহমষধফবংয শীর্ষক প্রস্তাবটি Nomination file no.1112 হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করেছিল এবং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইউনেস্কোর নিকট দাখিল করেছিল।’
সংশ্লিষ্ট দেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা আইসিএইচ) যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরার কাজ করে ইউনেস্কো। এ সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষর করা সব দেশ প্রতি বছর নিজেদের যে কোন একটি উপাদানের স্বীকৃতি চেয়ে ইউনেস্কোতে আবেদন করতে পারে। আইসিএইচ’র তিনটে বিভাগে এখন (২০১৭) পর্যন্ত বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৪৭০টি ঐতিহ্যবাহী উপাদান জায়গা পেয়েছে।
স্বীকৃতি দেবার মূল কাজ করে ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফ গার্ডিং অব দি ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কমিটির দ্বাদশ সম্মেলন চলছে দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে। কমিটির আলোচ্যসূচীর মধ্যে অন্যতম ছিলো ২০১৭ সালের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা অনুমোদন। এতে ২৪ সদস্যের মূল কমিটির বিবেচনায় পাঁচটি ক্যাটাগরির সব ক’টিতে শতভাগ নম্বর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়। কমিটি এছাড়াও আরো ১৯টি দেশের ১৫টি নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দেয়। জাতীয় জাদুঘরের সচিব শওকত নবীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন জাদুঘরের কিপার ড. শিখা নূর মুন্সী, ডেপুটি কিপার আসমা ফেরদৌসী এবং প্র্যাকটিশনার হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেন প্রখ্যাত পাটিকর গীতেশ চন্দ্র দাশ ও হরেন্দ্র কুমার দাশ।
সিলেটের শীতলপাটির বিশ্বজয় সম্পর্কে বিশিষ্ট ফোকলোর ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য কতো গভীর, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে।
শীতলপাটির বিশ্বজয়ের আনন্দধারায় দাঁড়িয়ে এই শিল্প নিয়ে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। পাটিশিল্পের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হবে। এই শিল্পের সংরক্ষণ এবং এর কারিগরদের সার্বিক মানোন্নয়নের উদ্যোগে নেয়া আজ সবচেয়ে বেশী জরুরী। এই শিল্পের সাথে জড়িতরা প্রায় সবাই-ই নারী। এ বিষয়ে তাদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ না থাকা সত্বেও অসাধারণ বুনন করেন তারা। কাজেই উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং একই সাথে পাটিকরদের জীবনের মানোয়ন্নের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাহলেই টিকে থাকবে ঐতিহ্যের শীতলপাটি শিল্প এবং শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা।
সূত্র:
১.শরিফ উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি ঢাকা কতৃক প্রকাশিত ‘সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক গ্রন্থে সংকলিত আকসাদুল আলম, প্রিয়াম গোস্বামী, মহিউদ্দিন শীরু রচিত শীতলপাটি ও বেতশিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ
নন্দলাল শর্মা রচিত ‘সিলেটের সাহিত্যাঙ্গন’
শাহিন, শাহাব উদ্দিন, বালাগঞ্জের ঐতিহ্য শীতলপাটি, দৈনিক জালালাবাদ, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ষর>
দাশ, সুমন কুমার, শীতলপাটির ঠিকানা , প্রথম আলো ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭
দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ৯ ডিসেম্বর ২০১৭-তে প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিজ্ঞাপন।