প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-১৮

  |  ১২:১৭, জুন ১৯, ২০২০
www.adarshabarta.com

নোবেল পুরস্কার, ড. ইউনূস, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও দর্পণ ম্যাগাজিন

:: মোঃ রহমত আলী ::

ছিলেন দু’জন একই পথের যাত্রী। সুযোগের হাতছানি ছিল একটি দুর্লভ সম্মান অর্জনের। লক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু এক জনের হলো, অন্য জনের হলো না। এ সম্মান তাঁদের নিজেদের জন্য যতটা না কৃতিত্বের দেশের জন্য তা আরো বেশি গৌরবের। উভয়েরই লক্ষ্য ছিল শান্তির পায়রা হয়ে উড়াল দেয়ার। কিন্তু সে সুযোগ একজনের আসলেও অন্যজন ছিলেন ডানা মেলে অপেক্ষায়। কিন্তু তা আর হলো না। কারণ উভয়ের লক্ষ্য ছিল একই দিকে। অর্থাৎ শান্তিতে বিশ্ব জয় করার। তাই একটি ভূখন্ড থেকে একজন হয়ে গেলে আরেকটিতে বিলম্ব হয় বা আদৌ হয় না। যদি ভিন্ন পথের যাত্রি হতেন তবে হয়তো আমাদের বিশ্ব বিজয়ে আরো একটি পলক যোগ হতো। আর আমরা আবারো আনন্দে উচ্চসিত হতাম।

আমাদের দেশের এই দুই দিকপালের নাম ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তাঁরা দেশের যতটা পরিচিত তার চাইতে বেশি পরিচিত ও সম্মানিত বহির্বিশ্বে। সাথে সাথে তাঁদের দুই কর্মযজ্ঞ মাইক্রোক্রেডিট ও ব্রাক। যেখানেই যান সেখানে দেশের সরকার প্রধানসহ উচ্চ পর্যায়ের ভিআইপিরা তাঁদের স্বাগত জানান। তখন শুধু তাঁদের কথা আলোচনা হয় না সাথে সাথে বাংলাদেশের কথাও উচ্চারিত হয়।

আলোচিত হতে থাকে তারা বিচরণ করেছেন।
এ দু’জন ভিআইপির বিরাট কর্মযজ্ঞের কাছে দর্পণ ম্যাগাজিনের অবস্থান সাগরের মধ্যে ক্ষুদ্র বালু কনার মত। তা ছাড়া তাঁদের মত লোকজনের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক উচ্চমনের পত্রপত্রিকার তুলনায় হয়তো দর্পণ তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু তবুও তাঁরা দর্পনকে হাতে নিয়েছেন, পড়েছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাদের সংবাদ প্রকাশের জন্য। আর এতে আমিও গর্বিত হয়েছি তাঁদের সাহচর্য লাভের জন্য। তাই এর সাথে সাথে দর্পণ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক জনাব এলাইছ মিয়া মতিনসহ অন্যান্যদের ধন্যবাদ জানাই এটা প্রকাশ অব্যাহত রাখতে সার্বিক সহযোগিতার জন্য। আশা করি আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

ড, মোহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হয়। এ সংখ্যাটি তিনি যখন লন্ডনে সংবর্ধিত হন তখন তাঁকে প্রদান করা হয় তখন তিি একটি সংখ্যা নেন ও এ জন্য দর্পণের সাথে সংশ্লিস্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। অনুরুপভাবে একসময় স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়েও দর্পণে প্রচ্ছদ পৃতিবেন করা হয়। এর পর চ্যানেল এস টেলিভিশনের কারেন্ট এ্যাপেয়ার্স এডিটর তানভির আহমদের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে তাঁকেও কয়েকটি সংখ্যা দেয়া হয়। তিনি তা দেশে নিয় যান ও প্রবাসীরা দেশে গেলে তাদের কাছে ম্যাগাজিনটি প্রদর্শন করে এর সার্বিক সফলতা কামনা করতেন।

সে যাই হউক, ১৯০১ ইংরেজিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। সে বছরে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এবং অন্যান্য সাধারণ গবেষণা, উদ্ভাবন, মানবকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মাধ্যমে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ পুরস্কারকে সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচাইতে সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তদের ইংরেজিতে বলা হয় নোবেল লরিয়েট।
অর্থনীতি ছাড়াও অন্য বিষয়গুলোতে প্রতিষ্ঠার সাল থেকেই পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সাল থেকে। অবশ্য প্রথমে আলফ্রেড অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। বর্তমানে মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সেগুলি হলো পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, অর্থনীতি, সাহিত্য ও শান্তি । শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় আসলো নরওয়ে থেকে। বাকি সব ক্ষেত্রে এ পুরস্কার প্রধানের আয়োজন করা হয় স্টকহোম ও সুইডেন থেকে।

যারা পুরস্কার পান তারা একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। এর বর্তমান অর্থমূল্য মূল্য ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার বা ১০ লাখ ৭০ হাজার ইউরো অথবা ১৪ লাখ মার্কিন ৮০ মার্কিন ডলার। সময় বিশেষে টাকার মান অনুযায়ি তা পবির্তনযোগ্য।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ইউনূস বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সহ আরও অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন।

নবেল বিজয়ি ইউনূছের জন্ম ২৮ জুন ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। তার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। তার প্রথম বিদ্যালয় মহাজন ফকিরের স্কুল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বয়েজ স্কাউটসে যোগ দেন এবং এর পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিনী ডঃ আফরোজী ইউনুস।
তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। কলেজে তিনি নাটকে অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। তা ছাড়াও তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা এবং বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেন ।
এরপর ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে পরে ১৯৭৫ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

ইউনুস ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময় তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়। মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক “সংহতি দল” পদ্ধতি ব্যবহার করে। এরপর অন্যান্য পদ্ধতিও যোগ হয়। যেমন গৃহঋণ, মৎস খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্প। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমন কি যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্ভুদ্ধ করা হয়।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২৭ এপ্রিল ১৯৩৬ জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নে তাঁর অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি অনেক পুরস্কার লাভ করেন। তার মধে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ম্যাগসেস পুরস্কার, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, লিও তলস্থয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পদক, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার এবং গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের নোবেল বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার ইত্যাদি।

২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের “বিশ্বের ৫০ সেরা নেতার তালিকা” তাঁর নাম সন্নিবেশিত হয়। তিনি স্বনামধন্য গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল অন্ট্রপ্রনোরশিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারিদ্র বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সবচেয়ে সম্মানিত অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জের নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করে। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডের রাজা তাঁকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেন।

তাঁর সম্মানসূচক ডিগ্রিতে রয়েছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স (২০০৭), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯) ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০১৪) ইত্যাদি।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেনী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে কুমিল্লা জেলা স্কুলে সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পাবনায় চলে যান সেখানে এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হোন। তিনি ১৯৫২ সালে সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে ভর্তি হন। দু’বছর পরে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডন চলে আসেন এবং এখানে পরবর্তীকালে চাটার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে চার বছরের পেশাদার কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অব ল্য’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রিলাভ করেন।
একসময় প্রভাব, উদ্ভাবনশীলতা, টেকসই সমাধান এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা এনজিও অ্যাডভাইজার ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ব্র্যাককে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন পদ থেকে অব্যহতি নেন এবং চেয়ার এমেরিটাস পদ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ মৃত্যবরণ করেন।
(চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com