জীবনের কথা, পর্ব-১৯
আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশে গিয়ে বাউল গানে ও পানে আসক্ত হয়েছিলেন
:: মোঃ রহমত আলী ::
একজন বাঙালি হয়েও ব্রিটিশ সরকারের হাই কমিশনার হয়ে আমাদের জন্য গৌরব বয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। এজন্য বৃটেনের বাঙালিসহ বিশ্বময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালি মাত্রই সবাই গৌরবের অধিকারী হন। যে যাই বলুন, যে ব্রিটিশরা আমাদেরকে দুইশত বছর শাসন করেছিল তাদের প্রতিনিধি হওয়টা অনেক বড় একটি বিষয়। তবে যতই তিনি ব্রিটিশদের দায়িত্ব পালনে ব্রতি হন না কেন তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালির মত। এ কথা বার বার প্রমানিত হয়েছে। ছোটবেলা বিলেতে আসার পর তিনি যতই ইংরেজদের ধ্যান ধারনায় বড় হন না কেন, বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যেখানেই দেখেছেন সখোনেই তা লালন করার চেষ্টা করেছেন। আর তাইতো বাংলাদেশ দায়িত্ব পালনে গিয়ে তিনি তা আরও বেশি মাত্রায় উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমার স্মরণ আছে যে, বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহনের পূর্বে যখন ব্রিকলেন বাংলা টাউনের তৎকালীন কাফে নাজ রেস্টুরেন্টে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন তাঁকে বলা হয়েছিল যে, তিনি বাংলা কথা বলতে পারেন কিনা। এসময় নিজেই তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সকলকে হাসিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমি কিতা বাংলা মাত্মাম খউকা ছাইন”। তখন সবাই মনে করেছিলেন যে তিনি যতই ব্রিটিশ ধারণায় জীবন ধারণ করেন না কেন, মনেপ্রাণে তিনি একজন খাঁটি বাঙালি এবং একজন প্রকৃত সিলেট প্রেমি। যদিও বাংলাদেশে যাওয়ার পর যখন তিনি সিলেটে গিয়ে বোমা হামলার শিকার হয়েছিলেন তখন আমরা অনেকেই আশাহত হয়েছিলাম, সাথে সাথে ব্যতীতও হয়ে পড়েছিলাম এক্সট্রিমিস্টদের এ দূর্ব্যবহারের কারণে। তখন মনে করা হয়েছিল যে তিনি হয়তো বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসতে পারতে পারেন। আর যদি তা হতো তাহলে আমরা একেবারে বেইজ্জতি ও লজ্জার চুড়ান্ত সীমায় পৌছে যেতাম। কিন্তু তিনি তা করেননি। বলেছিলেন, দায়িত্ব ছেড়ে চলে আসবেন না। এতে প্রাণ গেলেও সেখানে থাকবেন। এর পর শুধু নির্ধারিত সময় নয় এর চেয়ে আরও বেশী দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশ্য একসময় সেই হামলাকীদের বিচার হয়েছে এবং শাস্তিও হয়েছে।
তিনি যখন বাংলাদেশের ছিলেন, তখন হয়তো মনে করেছিলেন যে, সিলেটের গ্রামে- গঞ্জে গিয়ে গিয়ে ভ্রমণ করবেন। নিজ এলাকার মানুষের সাথে আরো বেশি করে মিলিত হবেন। কিন্তু সে সূযোগ আর দেশে থাকতে হয় নাই। এই বোমা হামলার ঘটনার পরে তার চলাফেরায় কিছুটা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এজন্য তিনি ঢাকার বাইরে খুব কমই গেছেন এবং সেখান থেকেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
আমরা জেনেছি যে, তিনি দেশ থেকে চলে আসার সময়ে চোঁখের জলে ভাসিয়েছেন বিমানবন্দর। বলেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে আসতে তাঁর মন চাচ্ছে না। তবুও আসতে হয়েছিল অন্যত্র দায়িত্ব পালনের কারণে। তবে যে সমস্ত স্মৃতি তাঁর এই সময়ে বেশী মাত্রায় আমরা জানতে পেয়েছি তার মধ্যে ছিল, বাউল গান তিনি খুবই পছন্দ করতেন এবং সেটা ছিল শাহ আব্দুল করিমের লেখা গান। আর কালা মিয়ার কন্ঠে হলেতো আর কথাই নাই। তার সাথে গলাগলি করে সুর মিলাতেন একসাথে। মাঝেমধ্যে নাকি তাদেরকে তিনি আমন্ত্রণ করে গানের আসর করতেন এবং এসময় তিনি আত্মভোলা হয়ে যেতেন। এমতাবস্থায় কোন কোন সময় গানের সাথে নাচও করতেন। এমনকি মঞ্চে উঠে শিল্পীর সাথে সুর মিলিয়ে গান গাইতেও তিনি দ্বিধা করেননি। এতে অনেকে আনন্দ পেতেন এবং তাকে নিয়ে সমস্বরে গান পরিবেশন করতেন।
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি শিল্পী রুনা লায়লার সাথে একই মঞ্চে গান করেছেন বলে তখন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকশিত হয়। তাছাড়া দেশের নারী শিল্পীদের গাওয়া গান তিনি বেশ পছন্দ করতেন। তাঁর মধ্যে শাহনাজ বেলি ছিলেন অন্যতম। তাইতো তিনি লন্ডন আসার পরেও বৃটেনে যখন বৈশাখী মেলা হতো তখন তিনি এখানে ছুটে আসার চেষ্টা করতেন। মাথে সাথে দর্শকদের সারিতে গিয়ে গান ধরতেন।
অন্য আরো যে বিষয়টির প্রতি তিনি বেশী আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন সেটা ছিল পান সুপারী। দেশে থাকতে নাকি এগুলা তিনি ক্রয় করার ব্যবস্থা করতেন ও নিজ বাসায় বসে তা মনের আনন্দে খাওয়া-দাওয়া করতন। বৃটেনে আসার পরেও তা অব্যাহত রাখেন এবং কোথাও আমন্ত্রিত হয়ে গেলে পান সুপারির সন্ধান করতেন। এভাবে একটি অনুষ্ঠানে এসে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন পান-সুপারি আছে কিনা। আমি তখন তাঁকে আমার পকেট থেকে কিছুটা পান-সুপারি বের করে দিলাম। তখন তিনি তা পরম আনন্দে গ্রহণ করলেন এবং আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। আমিও তাতে প্রীত হলাম। ভাবলাম, তিনি সেই আসক্তি এখনো বহাল রেখেছেন। হয়তো আগামীতেও তা অব্যাহত রাখবেন। আর এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতি ও কালচার এর প্রতি অনুরক্ত থেকে বাকি জীবন অতিবাহিত করবেন।
আর সত্যিই এমন কোন বিষয়ে কেউ একবার আসক্ত হয়ে গেলে তা থেকে মুক্তি পেতে কষ্ট হয়। তাই সেগুলি হয়তো তিনি বহাল রাখবেন এবং সময় সুযোগমতো তা গ্রহণ করবেন। এই আসক্তি থেকেই কোন কোন বিষয়ে মানুষ অনেক সময় এমনভাবে এডিকটেড হয় যা থেকে আর মুক্তি পাওয়া যায় না। আর তখনই সেটা হয়ে যায় জীবনের জন্য বৈরী। তখন মানুষ ভুল করে বসে আর সে কারণে সংসারে ঝামেলা হয় অথবা চাকুরিতে সমস্যা পোহাতে হয় । তাই কারো মধ্যে যদি সে ধরনের কোন আসক্তি থাকে তা হলে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্ঠা চালাতে হবে নতুবা তা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণ হতে পারে। তাই অনুরোধ করবো কোন সময় কেউ কিছুতে আসক্ত হয়ে গেলে তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। এমতাবস্থায় কারো অবস্থা যদি এ রকম হয়ে যায় তবে তা থেকে বিরত থাকাই ভালো। আর এটাই হবে আমার বিশেষ পরামর্শ। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com