প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-২১

  |  ১৬:০৪, জুন ২২, ২০২০
www.adarshabarta.com

রাজনীতির রহস্য পুরুষ বলে খ্যাত সিরাজুল আলম খানের সাথে লন্ডনে একধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে

:: মোঃ রহমত আলী ::

কেউ বলেন রাজনৈতিক নিউক্লিয়াস, কেউ বলেন খলনায়ক, আবার কেউ বলেন ষড়যন্ত্রকারী- এগুলিই হলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের পরিচিতির সূত্র। এ সবগুলি মিলিয়ে তাই তাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক রহস্য পুরুষ হিসাবে আলোচনা করা হয়ে থাকে। অনেকে আবার ‘দাদা ভাই’ হিসাবেও সম্বোধন করেন। তাই এ মানুষটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেকের রয়েছে। তবে আগামী প্রজন্ম তাঁকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা ইতিহাসই বলে দেবে সময়ের পরিক্রমায়। আমি তাঁর সম্পর্কে যতটুকু অবগত হয়েছি তা কেবল তাঁর ব্যাপারে লেখালেখি পাঠ করে। এর চাইতে বেশী কিছু আমার বলার নাই। তাই তাঁকে কোন্্ হিসাবে ইতিহাসে স্থান নির্ধারণ করবো সেটাও এখন পর্যন্ত আমার বোধগম্য হয় নাই। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ে তাঁর ভ‚মিকার কারণে আমি তাঁকে অবশ্যই মূল্যায়ন করি। আমি যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয় ছিলাম কিন্তু সে সময় তাঁর সম্পর্কে আমার তেমন জানার সূযোগ হয় নাই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে যতটুকু জেনেছি সেটাই এ ব্যাপারে আমার একমাত্র সম্ভল। তবে তিনি বিভিন্ন সময় যুক্তরাজ্য সফরে এসেছেন, এমতাবস্থায় কোন সময় সেন্ট্রাল লন্ডনের হাইড পার্ক, কোন সময়ে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল, আবার কোন সময় বাংলা টাউন ব্রিকলেনে দেখা হয়েছে। এ সময় অনেকের সাথে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করতে দেখেছি। এ অবস্থায় তাঁর সাথে স্বাক্ষাৎ হলেও শুধু ছবি তোলা ছাড়া আর তেমন কোন কথাবার্তা হয়নি।
তবে কথাবার্তা না হলেও তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আলাপ না করেও অনেক কিছু জানার সূযোগ হয়েছে। যেমন, তাত্তি¡ক এ নেতার জন্ম পঞ্চাশের দশকের একেবারে শুরুতে। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ হলেও বাবার কর্মস্থল খুলনার জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু এ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় একটি মুভমেন্টে অংশ নেয়ার কারণে। আর সে বিশ^বিদ্যালয়ের হল থেকে বের করে দেয়া হয় রাতে বেশী দেরী করে ফিরার কারণে।

সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬২ সনে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তিনি ছিলেন অগ্রগন্য। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন জনাব খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর তৎকালীন ক্ষমতাশীন দল ও দলের নেতার সাথে সরকার গঠন প্রশ্নে মতপার্থক্য সৃস্টি হয়। এরপর গঠন করা হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ। এরপর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। আর বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে অন্তত সাত বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়ার আমলে পুনরায় গ্রেপ্তার এবং পরে ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হলে কয়েক মাস পর মুক্তি পান। এরপর আর তেমনভাবে সক্রিয় দেখা যায়নি।

সিরাজুল আলম খানের পাট্য বিষয় অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তার অগাধ জ্ঞান এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় ১৯৯৬-’৯৭ সনে। আর্থ-সামাজিক বিশেষনে সিরাজুল আলম খান তাত্তি¡ক উদ্ভাবনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
তিনি চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চল ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তি সমূহের ‘বিষয় ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি। বাংলাদেশের অন্য জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও তার চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে শিল্পায়ন করার লক্ষ্যে প্রবাসীদের অর্থায়নে ‘উপজেলা শিল্প এলাকা’ এবং ‘পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করার তার প্রস্তাবও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘মাইক্রো ক্রেডিট’ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ‘সামাজিক ব্যবসা’-এর সমর্থক তিনি। সিরাজুল আলম খান এখন দেশে-বিদেশে ‘রাজনৈতিক তাত্তি¡ক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত।

তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক এক বিষ্ময়কর ব্যাপার বলে পরিগনিত হয়। তাঁর রাজনৈতিক তত্ত¡ উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল প্রনয়নে অনেক সহযোগি ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুল আলম খান অবিবাহিত। তাঁর চুল ও গোঁপের কারণে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাই যুক্তরাজ্যে আসলে তাঁকে আমরা অনেক দূর থেকে চিনতে পারি। ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেলে একবার সাবেক জাসদ নেতা সৈয়দ আব্দুল মাবুদের সাথে বেড়াতে গেলে তিনি দূর থেকে আমাকে দেখিয়ে দেন এই বলে যে, ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন তিনি হচ্ছেন, বাংলাদেশের আলোচিত রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খান। এর পর যে কোন সময় দেখা গেলে আর চিনতে অসুবিধা হয় না।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com