প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-২৭

  |  ১৪:১৩, জুন ২৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. শফিক সিদ্দিকের অসুস্থকালীন সময়ে লেখা ‘তোমাদের ভালোবাসা ফিরিয়ে এনেছে মোরে’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও কিছু কথা

:: মোঃ রহমত আলী ::

বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিয়ে লেখার মত দৃষ্ঠতা প্রদর্শন আমি করি না। আর আমার মত এক ক্ষুদ্র কলম সেনিকের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। তবে যে কারণে আমার ধারাবাহিক লেখার এ পর্বে তাঁদের সম্পর্কে কিছুটা তুলে ধরার সাহস ও অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি, তা এ লেখাটির শেষ দিকে উল্লেখ করেছি। আশা করি, সেটা থেকে পাঠকগণ উপলব্ধি করতে পারবেন, কেন এবং কী কারণে আমি তা লিখতে গেলাম।
বঙ্গবন্ধুর ছিলেন, দুই জামাতা। বড় জন হলেন, পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া আর আর ছোট জন হলেন, ড. শফিক সিদ্দিক। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে একজন পরলোকগত। অন্যজন জীবিত। শফিক সিদ্দিক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কর্ণধার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত তাঁকে নিয়েই আজকের লেখা।

শুরুতেই বলে নিতে চাই যে, ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ড. শফিক সিদ্দিক-এর সাথে শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হয় লন্ডনের কিলবানের্, এ পরিবারের সুখ দুঃখের সাথী, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে। শফিক সিদ্দিক তখন বিলেতের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষারত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় থাকাকালীন তিনি দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আসেন। শেখ রেহানাও ৭৫ এর ঘটনার পর বড়বোন শেখ হাসিনার সাথে জার্মান থেকে দিল্লি চলে যাওয়ার পর সেখান থেকে লন্ডনে চলে আসেন। বিয়ের আগে শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানার উভয়ের পরিবার ছিলেন পুর্ব পরিচিত। বর্তমানে এ দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেম্বার। ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। আর ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক।

শফিক সিদ্দিক একসময় একটি বড় ধরণের স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর ডুবাই গিয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসারত থাকাবস্থায় ও পরবর্তী সময়ে একটি বই লেখেন। এতে বিশেষ করে তিনি নিজের অসুস্থতার সময়ের নানা অনুভূতি, স্মৃতি ও সমসাময়িক কিছু ঘটনা বর্ননা করেছেন।। আর এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। যার নাম, ‘তোমাদের ভালোবাসা ফিরিয়ে এনেছে মোরে’।

মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে এবং পরে তা থেকে উত্তরণ ঘটে তখন সে সময়ের স্মৃতিগুলি ভুলতে পারেনা। এটা কেবল শফিক সিদ্দিক এর বেলায় নয়, অনেকেই তা লিখেছেন অথবা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আর সময়-সূযোগমত সেটা প্রকাশ করেছেন। অতি সম্প্রতি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কভিড-১৯ এর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর সুস্থ হয়ে তিনি বই লিখতে না পারলেও অসুস্থকালীন হাসপাতালে তাঁর পরিচর্যা কাজে নিয়োজিত কয়েকজনের নাম বলেই দিলেন। আর এর ফলে তারা চলে গেলেন তারকাখ্যাতির পর্যায়ে।
সে যাই হোক, ডক্টর শফিক সিদ্দিক এর এ বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়েছিল লন্ডনে। স্থান ছিল ইস্ট লন্ডনের হোয়্ইাট চ্যাপেল রোড এর একটি হল। তারিখ ছিল ২৭ আগস্ট ১৯৯৫ ইংরেজি। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, লেখক আব্দুল মান্নান, ড. মোহাম্মদ সেলিম, শিল্পী ফরিদা রহমান, গীতিকার আহমেদ হোসেন সহ আরো অনেকে। সভাপতিত্ব করেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং পরিচালনা করেন সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক। আমারও সূযোগ হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার।
অনুষ্ঠান যখন শুরু হল তখন একে একে সবাই বক্তৃতা করে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রশংসা করা হচ্ছিল। শফিক সিদ্দিক তখন ছিলেন, খুবই নীরব এবং অনেকটা নির্বিকার। তিনি বার বার তাকাচ্ছিলেন সবার দিকে। তখন মনে হয়েছিল যে, তিনি যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে এবং সবাইকে নতুনভাবে দেখছেন। তারপর তার বক্তৃতা দেওয়ার সময়ও কথাবার্তায় বেশ আড়ষ্টতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কারণ তখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।

এ অনুষ্টানের পর ২৩ নভেম্বর ১৯৯৫ ইং দ্বিতীয়বার ড.শফিক সিদ্দিকের সাথে আমার দেখা হয়। তখন তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। আর দেখা হওয়ার উপলক্ষ ছিল লন্ডনে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের’ একটি সভা। এ সভাটি ইস্ট লন্ডনের ২৯৩ হোয়াইট চ্যাপেল রোডের যুক্তরাজ্য ইয়ুথ লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত হয়। আমি সেখানে সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগদান করি। এ সভায় তখন ট্রাস্টের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ৫সদস্য বিশিষ্ট একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয়ার পর এটা সম্প্রসারনকল্পে ও ট্রাস্টের কিছু নীতিমালার বিষয়ে আলোচনা হয়।

এরপর আর দীর্ঘদিন আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের সূযোগ পাইনি। তবে তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এমপি হওয়ার পূর্বে যখন ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর ছিলেন, তখন সে কাউন্সিলের একটি সভায় আলাপ প্রসঙ্গে তাঁর পিতার কথা জিজ্ঞাসা করি। তখন টিউলিপ “তিনি ভাল আছেন ও সুস্থ আছেন” এ কথাটি বলার পর যে উক্তিটি তার কাছ থেকে শুনেছিলাম তা আজও আমার স্মরণ আছে। সে বলেছিল যে, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) আছেন বলেই আমরা আছি, আপনাদের সকলের জন্য শুভকামনা’। আমি তখন তার এ উক্তিটির মাধ্যমে ধারণা করতে পেরেছিলাম যে, মানুষকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হয়- সেটা তার উপলব্দিতে আছে। এবং যেহেতু সে একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য, তাই তার ভবিষ্যৎ উজ্জল। এরপর আমার দর্পণ ম্যাগাজিনে তার সম্পর্কে বিভিন্ন সময় লিখেছি। বিশেষ করে এমপি নির্বাচনের বেলায়।

২০১৬ সালে আমি বাংলাদেশে যাওয়ার পর ঢাকায় ‘বাংলা ভিশন’ টেলিভিশন এর ‘প্রবাসী মূখ’ নামক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য উপস্থাপক মোস্তফা ফিরোজ ভাই আমাকে আমন্ত্রন জানান। আমি সেখানে গেলে সৌভাগ্যক্রমে ড. শফিক সিদ্দিকের সাথে আমার তৃতীয় বারের মত দেখা হয়ে যায়। এসময় তিনিও সে টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন। অনেকদিন পর তাঁর সাথে আমার দেখা। তখন আমি কোশলবার্তা জিজ্ঞার পর সংক্ষিপ্ত কিছু কথাবার্তা হয়। কারণ আমাদের অনুষ্ঠানও তখন শুরু হতে যাচ্ছিল।
এবারে লেখার মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করছি। এ বইয়ের একটি অংশে তিনি লিখেছেন, “যখন আমি ঘরে থাকি তখন সাধারণত আমিই ফোন রিসিভ করি। কিন্তু আজ আমার ঘরের প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি বই, আমার প্রত্যাহিক প্রয়োজনের প্রতিটি খুঁটিনাটি সবই আমার আগের মতই আছে। কোথাও কোনো কিছুরই পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু এখন আমার সে শক্তি নাই। আজ আমার উঠার শক্তি নেই। কোন কিছু করার শক্তি নেই। আমি কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারিনা। হাটতে পারি না। আমার শরীরের ডান পাশ কাজ করছে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমার কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। এত অস্পষ্ট যে, আমার কথা অনেকের বুঝতে পারছে না। অথচ এই মাত্র কয়েকমাস আগেও তো আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছি। মানুষের জীবনে খুব একটা দীর্ঘ সময় হয়তো কিছুই নয়। আবার হয়তো একটি মুহূর্র্তও জীবন পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট। সেটা উপলব্দি করি আমার জীবনের কঠিন বাস্তবতার নিরিখে”।
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “আমি অসুস্থ হওয়ার পর যখন হসপিটালে যাচ্ছিলাম তখন আমার মনে হল যে, আর হয়তো কখনো ফিরে আসা হবে না। তখন আমার ছোট মেয়ে রুপন্তি ঘুমিয়ে ছিল, ওকে তাকিয়ে দেখলাম। জেগে থাকা ববি ও টিউলিপের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলাম। আমার মনে হলো আর হয়তো কখনো তাদের আমি দেখতে পাবো না। আমার ছেলেমেয়ে দু’টো আমার অবস্থা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল”।

এরপর আমি হসপিটালে যাওয়ার পর আমাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হল। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন নিউমোনিয়া জাতীয় ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়েছি। সে সময় আবারও প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম। এমতাস্থায় আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। এ সময় আমাকে প্যাথেডিন ইনজেকশন দেওয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পরই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। অন্য এক জায়গায় বলা আছে, ‘অপারেশনের পর একসময় ডাক্তাররা তাঁর আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন’।
কিন্তু আরোগ্য লাভের জন্য লেখক যেকোনো কষ্ট স্বীকার করতে রাজি ছিলেন। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পাবার তীব্র আকাংখা ও মনোবল শেষ পর্যন্ত তাঁকে চরম পরিণতি থেকে রক্ষা করেছিল। তাঁর এ মানসিক অবস্থা বইয়ের উৎসর্গ পত্রে যুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া শারীরিক কারণে তার ছোট মেয়ের ঘুরাফেরা, খেলাধুলার ব্যাপারে সঙ্গ না দেয়া এবং স্কুলে না নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিজের মনোবেদনা না ছিল তা থেকে শতগুণ বেশি ছিল, বড় হয়ে পড়বে সে এই বই এবং তার বাবার অক্ষমতার কারণ অনুধাবন করতে পারবে।
এ সমস্ত ঘটনা গুলির মধ্যে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে হৃদয়গ্রাহী বিবরণ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করা স্বাভাবিক। তাই বইটি পাঠক প্রিয় হবে বলে প্রত্যাশা। আর আমিও এ সূযোগে একটি পর্ব লিখে নিলাম। সাথে সাথে সে বইয়ের প্রকাশনাকালীন আমার নিজের তোলা ও বিগত ২৫ বছর থেকে সংরক্ষনে রাখা সংশ্লিষ্ট ছবিটি প্রদর্শন করলাম- এটাই আমার এ লেখার মূল উদ্ধেশ্য। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com