জীবনের কথা, পর্ব-৩৪
সিনেমা দেখা পর বুঝলাম ‘এই ছবি সেই ছবি নয়’
:: মোঃ রহমত আলী ::
আমি শুধু লেখালেখি করি না। মাঝেমধ্যে ছায়াছবি, নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করে থাকি। সেগুলার অনেকটা ইচ্ছায়, অনেকটা অনিচ্ছায় আবার কখনো আকস্মিকভাবে হয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, একটি ইংরেজি ফিল্ম ও একটি বাংলা শর্ট ফিল্ম। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে, আমি বিভিন্ন সভা সমাবেশে উপস্থাপনা, ফুটবল খেলায় ধারাবিবরনী ও রেপারী হিসাবে কাজ করেছি। যার ফলে আমার জীবন বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে আছে।
স্কুল জীবনে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছি। তবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের প্রথম স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এর একটি নাটক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ নাটকটি রচনা করেন আমাদের স্কুলের বি,কম স্যার জনাব আব্দুল মান্নান। আমার সেই সময়ের স্কুল জীবন সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামিশি হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত এ নাটকে আমি মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসাবে অভিনয় করি। আমার নাম ছিল ক্যা্েটন রফিক। আর আমি ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারের ভুমিকায়। যুদ্ধের সময় আমার বোনকে পাকসেনারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। আর অমনি আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে বন্ধুক দিয়ে সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করি। এ দৃশ্যটি ছিল নাটকের শেষ পর্যায়ে। আমার এখনও স্মরণ আছে যে, এ ব্রাশ ফায়ার করার পর তারা যখন ধরাশায়ি হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনেকটা আবেগ তাড়িত হয়ে মাঠের দর্শকরা বাঁশের বেস্টনী অতিক্রম করে আমাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ও জড়িয়ে ধরে। পাশাপাশি পাকসেনাদের ভুমিকায় যারা অভিনয় করেছিল তাদের প্রতি ক্ষেপে যায় এবং মারতে উদ্যত হয়। অবশ্য স্যারদের হস্তক্ষেপে সেটি তখন রক্ষা হয়েছিল। সে আবেগ তাড়িত হওয়ার একটা অন্যতম কারণ ছিল, সে এলাকায় পাঞ্জাবিরা হত্যাকান্ড চালানোর পর গ্রামের ও বাজারের বিরাট ক্ষতিসাধন করে।
এরপর আমি বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর এন ইউ হাইস্কুলে স্কুলে শিক্ষকতায় থাকাকালীনও একটি নাটকে অংশ নেই। তবে লন্ডনে আসার পর একটি নাটকে সাংবাদিক হিসাবে ভূমিকার মূল বিষয় ছিল, দেশ থেকে যুক্তরাজ্য সফরে আসা এক রাজনৈতিক নেতাকে প্রবাসীদের সম্পর্কের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা। নাটকটি দেখে অনেকে অনুমান করতে পারছিলেন না যে, আমি সত্যি অভিনয় করছি না বাস্তবে কোন প্রেস কনফারেন্সে সেই নেতাকে প্রশ্ন করছি। কারণ প্রেসক্লাবসহ নানা প্রেস কনফারেন্স এর সংবাদে তারা আমাকে টেলিভিশনে বিভিন্ন সময় দেখে থাকেন। নাটকটি প্রচারের পর অনেকে আমাকে এই নেতার নাম এবং কোন এলাকার এমপি তাও জানতে চেয়েছিলেন। তাদের অনেকে ধারণা করাতে পারেননি যে, এটা ছিল নাটকের চরিত্রের অভিনয়কৃত সাংবাদিক ও এমপির ভূমিকা।
এরপর মিনহাজ কিবরিয়া পরিচালিত ও নির্দেশনায় “বাংলা টাউনে বাংলা প্রেম” নাটকে আমি অভিনয় করি। তখনও আমার একই অবস্থা হয়। এ নাটকটি ছিল ‘স্কাই বাংলা নামক একটি টেলিভিশনের মালিক হিসাবে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা। এতে যারা বিভিন্নভাবে কাজ করেন তারা একে অন্যকে কিভাবে যোগ্যতা থাকা সত্বেও বঞ্চিত করেন ও শুধু আশ^াস দিয়ে তাদের চাকরের মত খাটান সে গুলি অবলোকন করা। সাথে সাথে এর মধ্যে সুন্দরী মহিলাদের সাথে আড়ালে আড়ালে প্রেমলীলা চলানো ও কাজে ফাঁকি দেয়ার প্রচেষ্টার বিষয়টিও আমাকে খেয়াল রাখতে হতো। তা ছাড়া অনেক সময় মালিকের অনুপস্থিতিতে কেউ কেউ টিভির নাম ভাঙিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে থাকার প্রচেষ্টাও দেখভাল করতে হতো। এ নাটকটি প্রচারিত হওয়র পর আমাকে অনেকে সে টিভিটি কখন শুরু হলো এবং কিভাবে তা দেখা যায় সে ব্যাপারে জানতে চান। আসলে এটা ছিল একটা ‘কাল্পনিক নামমাত্র টিভি’ এবং এর কোন বাস্তবভিত্তিক অবস্থান ছিল না।
আমার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় বিষয় ছিল বিবিসি ওয়ান টেলিভিশনের দুই পর্বের একটি পুর্ণ ্ৈদর্ঘ ছবিতে অংশ নেয়া। সে ছবিটির নাম ছিল “ইংল্যান্ডস এক্সপেক্টস’। বৃটেনের বর্নবাদ ও বাঙালি কমিউনিটির জীবনযাত্রা বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এটি। তবে ছবিতে অভিনয় এর ব্যাপারটা যাই হোক, আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এর সাথে সংশ্লিস্ট অন্য একটি বিষয় নিয়ে আগ্রহ থাকার বিষয়টি। আর সেটি ছিল ছবির শুটিং চলাকালীন ‘স্টিল ক্যামেরায়’ তোলা বিভিন্ন ফটো সম্পর্কিত।
অনেকে হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে, ছবির শুটিং চলাকালীন বিভিন্ন কার্যক্রমে ভিডিও ক্যামেরাম্যান ছাড়াও আরো একজন ক্যামেরাম্যান থাকেন যার হাতে থাকে একটি স্টিল ক্যামেরা। যার কাজ হলো যেখানে অভিনয় চলে সেখানে অবিরত ফটো তোলা। আমিও যখন সেই ছবির শুটিংয়ে ছিলাম তখন অন্যান্যদের সাথে আমারও অনেকে ছবি তোলা হয়। আমি তখন ভিডিও কামেরার চাইতে বেশি আগ্রহী ছিলাম সেদিকে। কারণ সে আমার খুবই কাছে থেকে ছবি তুলেছিল। তাই আমার মনে হয়েছিল একসাথে দুই কাজ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ভিডিও হচ্ছে, অন্যদিকে স্টিল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। যাকে বলে ‘এক ডিলে দুই পাখি মারা’ অথবা ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’।
যাই হউক, ছবির শুটিং পরে আমার মনে হল সেই ক্যামেরাম্যান যতটি ছবি তুলেছে তার কিছুটাও যদি দেখানো হয় তবে তাতে আমি লাইমলাইটে চলে আসব। এরপর অপেক্ষা করতে থাকি অধীর আগ্রহ নিয়ে ছবিটি কবে দেখানো হবে। একসময় তা দেখানো হলো। আমি দারুণ আগ্রহ সহকারে তা দেখলাম। কিন্তু ভিডিও ক্যামেরার ছবি দেখা গেলেও স্টিল ক্যামেরার কোন ছবি দেখতে পেলাম না। এতে আমি দারুন হতাশ হলাম। এরপর এর কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, স্টিল ক্যামেরা দিয়ে যে ছবি তোলা হয়েছিল সে গুলি ফিল্মে দেখানোর জন্যে নয়। তা ছিল কে কোন পোশাকে অভিনয় করেন তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্যই সে ছবিগুলি স্টিল ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল যা- প্রত্যক ফিল্ম তৈররি সময় করা হয়ে থাকে। অনেক লম্বা ছবিতে যারা অভিনয় করেন তাদের কোন সময় কোন পর্বে কোন কাপড় পরা হয় সেটা পরিচয় রাখার জন্যই তা করা হয়। আসলে আমি যেভাবে চিন্তা করেছিলাম সেই ছবি ফিল্মের ছবি নয়। এটা আসলে তাদের ব্যক্তিগত সংরক্ষণের জন্য তোলা ছবি।
এবারে সিনেমা ও ক্যামেরার ব্যাপারে কিছুটা আলোচনা করা যাক। একটা ভাল সিনেমা বানাতে হলে যে সমস্ত বিষয় প্রয়োজন হয় তা হচ্ছে, পরিচালকের দৃস্টিভঙ্গি, সিনেমার গল্প, ভাল ক্যামেরা, যোগ্য অভিনেতা, কম্পিউটার। এবং একটা গল্প দাঁড় করানোর পর তার মাল-মশলা। এরপর সেটাকে ফ্রেমবন্দী করতে গেলে লাগবে ক্যামেরা। ক্যামেরার সামনে গল্পটাকে উপস্থাপন করতে লাগবে অভিনেতা। আর শ্যুট করা গল্পটাকে সাজিয়ে করানোর জন্য দরকার একটি কম্পিউটার।
ক্যামেরা¿ হলো আলোকচিত্র (ফটোগ্রাফ) গ্রহণ ও ধারণের যন্ত্র। দৃশ্যমান স্থির বা গতিশীল ঘটনা ধরে রাখার জন্য এটি ব্যবহার হয়। স্থির চিত্র, গতিশীল চিত্র, শব্দসহ চিত্র, রঙ্গিন চিত্র প্রভৃতি এর দ্বারা গ্রহণ করা সম্ভব। ক্যামেরা নামটি লাতিন পদগুচ্ছ কামেরা ওবস্কিউরা থেকে এসেছে, যার অর্থ “অন্ধকার প্রকোষ্ঠ”। অতীতে আলোকচিত্রগ্রাহী ফিল্ম অর্থাৎ আলোকসংবেদী পর্দায় চিত্রের নেগেটিভ বা ঋণাত্মক ছাপ সংগৃহীত হত। এই ঋণাত্মক চিত্রটিকে পজিটিভ বা ধনাত্মক করার জন্যে আলোকচিত্রের উন্নতিসাধন (ডেভেলপ) করতে হত। এখন আলোক ডায়লোড ও সিসিডি-যুক্ত ডিজিটাল ক্যামেরার আবির্ভাবের কারণে আলোকচিত্র গ্রহণ ও ধারণের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।
এদিকে, স্থির ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত ক্যামেরা যখন আবিস্কার হয় তখন থেকেই স্টিল ক্যামেরাই ক্যামেরা নামে চলে আসছে। ভিডিও ক্যামেরা আসার পর এর স্থির বা স্টিল নামটি যোগ হয়। আধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরাগুলো একই সঙ্গে স্টিল ও ভিডিও দুই ধরনের কাজই করতে পারে।
শুরুর দিকে মানুষের অবয়ব, বিভিন্ন শখের বস্তু, ইমারত ও নৈসর্গিক দৃশ্যকে ধরে রাখার জন্য নানা উপায়ে চেষ্টা চালানো হতো। এক পর্যায়ে শুরু হয় কলম ও রঙ-তুলির ব্যবহার। তারপর কাপড়, কাগজ ও পাথরের ওপর ছবি আঁকার প্রচলন শুরু হতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বড় বড় চিত্রকর, যারা সৃষ্টি করেন ইতিহাসখ্যাত চিত্রকর্ম। এরপর মানুষ ভাবতে থাকে ছবির বিষয়টিকে কীভাবে আধুনিকতার সংস্পর্শে আনা যায়। অর্থাৎ কীভাবে খুব সহজে নিখুঁত ছবি তোলা যায়। চলতে থাকে গবেষণা। আবিষ্কৃত হয় ছবি তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল। এরই ধারাবাহিকতায় চলে আসে ক্যামেরা তত্ত্বটি।
১০২১ সালে ইরাকের এক বিজ্ঞানী ইবন-আল-হাইতাম আলোক বিজ্ঞানের ওপর সাত খন্ডের একটি বই লিখেছিলেন আরবি ভাষায়, এর নাম ছিল কিতাব আল মানাজির। সেখান থেকে ক্যামেরার উদ্ভাবনের প্রথম সূত্রপাত। ১৫০০ শতাব্দীতে এসে চিত্রকরের একটি দল তাদের আঁকা ছবিগুলোকে একাধিক কপি করার জন্য ক্যামেরা তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৫৫০ সালে জিরোলামো কারদানো নামের জার্মানির একজন বিজ্ঞানী ক্যামেরাতে প্রথম লেন্স সংযোজন করেন। তখন ক্যামেরায় এই লেন্স ব্যবহার করে শুধু ছবি আঁকা হতো। তখনও আবিষ্কৃত ওই ক্যামেরা দিয়ে কোনো প্রকার ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ ওই ক্যামেরাকে সফল রূপ দিতে সময় লেগেছিল আরও অনেক বছর।
ক্যামেরার ইতিহাসে একটি মাইলফলক ছিল ১৮২৬ সাল। ওই সালেই প্রথমবারের মতো আলোকচিত্র ধারণের কাজটি করেন জোসেপ নাইসপোর নিপস। তিনি পাতলা কাঠের বাক্সের মধ্যে বিটুমিন প্লেটে আলোর ব্যবহার করে ক্যামেরার কাজটি করেন। সে হিসেবে তাকেই প্রথম ক্যামেরা আবিষ্কারক বলা যায়। তার ক্যামেরা সংক্রান্ত ধারণার ওপর নির্ভর করেই ফ্রাঞ্চমেন চার্লেস এবং ভিনসেন্ট ক্যাভেলিয়ার প্রথম সফল ক্যামেরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।
১৮৪০ সালে উইলিয়াম টালবোট স্থায়ি চিত্র ধারণের জন্য নেগেটিভ ইমেজ থেকে ছবিকে পজিটিভ ইমেজে পরিবর্তন করেন। এরপরই বিশ্বব্যাপী ক্যামেরার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে জর্জ ইস্টম্যান তার প্রথম ক্যামেরা ‘কোডাক’-এর জন্য পেপার ফিল্ম উৎপাদন করেন। বাণিজ্যিকভাবে এটাই ছিল বিক্রির জন্য তৈরি প্রথম ক্যামেরা। এর ঠিক এক বছর পরে পেপার ফিল্মের পরিবর্তে সেলুলয়েড ফিল্মের ব্যবহার চালু হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকানো হয় নি।
১৯৪৮ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় পোলারয়েড ক্যামেরা, যা দ্বারা মাত্র এক মিনিটে ছবিকে নেগেটিভ ইমেজ থেকে পজিটিভ ইমেজে রূপান্তর করা সম্ভব হয়। দীর্ঘ ৭৫ বছর অ্যানালগ ক্যামেরার রাজত্ব চলার পর ১৯৭৫ সালে কোডাকের স্টিভেন স্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবন করেন। এভাবেই আজ ক্যামেরা মানুষের হাতের মুঠোয়। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com