জীবনের কথা, পর্ব-৩৯
-
এক সময় কলাপাতার সিন্নিতেও তৃপ্তি ছিল এখন শুধু খাই খাই !
:: মোঃ রহমত আলী ::
লন্ডনে কোথাও আমি কলাগাছ দেখি নাই। তবে কলাপাতা দেখেছি। কিন্তু এই কলাপাতা সেই কলাপাতা নয়। এই কলাপাতা হলো একটি রেস্তেুারা। যার বাণিজ্যিক নাম ‘কলাপাতা রেষ্টুরেন্ট‘। ইস্ট লন্ডনে এ রেষ্টুরেন্টটির অবস্থান থাকায় স্থানীয় বাঙালীরা এটিকে শুধু ‘কলাপাতা‘ হিসাবেই চালিয়ে দেন। এভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে এই নামকরণের অভিধাটি। মনে হয়; যতদিন রেষ্টরেন্ট চলবে ততদিনই তা অব্যাহত থাকবে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সূযোগ আর হবে না রেস্তেুারাটির।
এদিকে বাংলাদেশে কিন্তু কলাগাছের অভাব নাই। হাঁটে, মাঠে, ঘাটে, বাড়ির আঙ্গিনায় সবখানেই কলাগাছ পাওয়া যায়। এ সমস্ত কলাগাছে কমবেশী ফসল উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে বাড়ীর আঙ্গিনায় যেগুলিতে কলা উৎপন্ন হয় সেগুলি সে বাড়ীর মালিকানায় যারা থাকেন তারাই ভোগ করেন আর অন্যান্য স্থানে যেগুলি উৎপন্ন হয় তার হিসাব কেউ রাখে বলে মনে হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফসলের কথা আলাদা।
এবারে ‘কলা পাতার’ প্রসঙ্গে আসা যাক্্। কলাগাছের কোন ডাল নেই। আছে শুধু পাতা। আর এটাই হলো আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। তবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় সিন্নিকে আবার ‘সীরনী’ও বলা হয়ে থাকে। গ্রামের সাধারণ মানুষ কলাপাতা ও সিন্নির সাথে স্ব-বিশেষ পরিচিত। তাই তারা কোন ছোটখাট খাওয়া-দাওয়ার বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে ‘কলাপাতার সিন্নি‘ হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন।
আমরা যারা ছোটবেলা কোন বাড়ীতে বা মসজিদে এ সিন্নির দাওয়াত পেতাম তখন খালি হাতেই সেখানে গমন করতাম। আর গমনের পর প্রথমেই শুরু হতো ‘বসার স্থান’ দখলের প্রতিযোগিতা। লম্বা লাইন ধরে কেউ বসে পড়ত আবার কেউ দাঁড়িয়ে থাকতো। কেউ কেউ আবার চালাকি করে দুই পা আগ বাড়িয়ে বেশী জায়গা দখলের প্রচেষ্টা চালাতো। তবে প্রতিক্ষার প্রহর বেশী হলে আস্তে আস্তে সে প্রচেষ্টায় ভাটা পড়তো।
এরপর শুরু হতো কলাপাতা বিতরণের পালা। প্রত্যেককে একটি করে পাতার অংশ বিশেষ দেয়া হতো। আর সে পাতায়ই দেয়া হতো সিন্নি। এ সমস্ত সিন্নির অধিকাংশটিতেই তরকারীর চামচের অর্ধেক পরিমাণ সিন্নি দেয়া হতো। এটা পাওয়ার পর কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে তা সাথে সাথেই গলদগরণ করে ফেলতো। আবার কেউ কেউ বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে ভাগ ভাটোয়ারা করে ভক্ষণ করতো। বয়স্করা আবার বাড়িতে নিয়ে এসে ছোটদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। আর এটা পরম তৃপ্তিসহকারে বাচ্ছারা উপভোগ করতো। এমনও দেখা গেছে শিশুরা যখন কান্নাকাঠি করতো তখন এ সিন্নি এনে দেয়ার কথা বল্লে তারা কান্না থামিয়ে দিত।
এই সিন্নি খাওয়ার পর কে কতটুকু তৃুপ্তি লাভ করতো তা বুঝতাম না। কিন্তু আশ^স্থ হতো যে, একটা কিছু হজম করা হয়েছে। অনেকে প্রশান্ত মনে বাড়ী ফিরতো। আত্মতৃপ্তির ভাব লক্ষ্য করা যেত ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও।
কিন্তু আজকালকার অবস্থা সম্পূর্ণরুপে ভিন্ন হয়ে গেছে। মসজিদে বা অন্য কোথাও আর সেই কলাপাতার সিন্নির আয়োজন তেমন একটা দেখা যায় না। তার বদলে হতে দেখা যায় বড় বড় পার্টি। যেমন ইফতার পার্টি, ঈদ পার্টি, জন্মদিনের পার্টি প্রভৃতি। আর এগুলি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে বা আলিশান হল সমুহে। সেখানে যে যতটুকু ইচ্ছা নিজ হাতে প্লেটে নিয়ে উদরপূর্তি করতে পারেন।
কিন্তু তাতেও অনেকের মধ্যে তৃপ্তির ভাব লক্ষ্য করা যায় না। সর্বত্র শুধু খাই খাই অবস্থা। যতই দিন যাচ্ছে ততই এ অবস্থা যেন বেড়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত এ সর্বগ্রাসী অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কারণ আমরা সেই আগের মত এখন আর কলাপাতার সিন্নির মত অল্পতে তুষ্ঠ নই। যার যতটুকু আছে তার চাইতে আরো বেশী করে পেতে চাই। আর এ জন্যই সর্বত্র চলছে অশুভ প্রতিযোগিতা। যেকারণে অস্থিরতা শুধু বেড়েই চলেছে।
এখানে কলাগাছ, কলাপাতা ও সিন্নি’র কথা রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে এ লেখায় তখনকার সময়ের আত্মতৃপ্তি এবং বর্তমান সময়ের তৃপ্তির কথাই তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। আমরা যদি আগের মত অল্পতে তুষ্ঠ থাকতাম তবে হয়তো সমাজে এত হানাহানি এবং অশান্তির সৃস্টি হতো না। একটি সূখী, শান্তিময় ও সমৃদ্ধিশালী সমাজে বসবাস করতে পারতাম আমরা। কিন্তু মহা দূর্যোগ কালেও এটা থেমে নেই।
সাম্প্রতিক করোনা মহামারিকালে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি, স্বাস্থ্য খাত, সরকারি গুদাম থেকে খাদ্য সামগ্রী আত্মসাৎ এর বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসার জন্য নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে এ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আসছে। এ ব্যাপারেও বিভিন্ন সংস্থায় মামলাও হচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এ সমস্ত কেলেঙ্কারীর তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়ে ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি উঠেছে। তাদের মতে, সরকারের নগদ সহায়তা যাতে সঠিকভাবে প্রকৃত হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্যোগে বিপন্ন, অসচ্ছলদের নিকট পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যারা এই অর্থ পাচ্ছেন বা পাবেন তাদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা উচিত।
তাদের দাবি, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে প্রধানমন্ত্রীর নানাবিধ উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু, তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় পর্যায়ে অনিয়ম ও বিতরণে অদক্ষতা এবং সমন্বয়হীনতা পুরো উদ্যোগকে প্রশ্নœবিদ্ধ করে তুলতে যাচ্ছে, যা মোটেই শুভ নয়, কাম্য নয়।
তাদের আরও দাবি, জাতির এই ঘোর ক্রান্তি লগ্নে সরকারের ত্রান ও নগদ সহায়তা যারা আত্মসাৎ করার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে তাদের নামের তালিকাও ছবি সহ জনগনের সামনে প্রকাশ করা উচিত। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ এধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হবার সাহস না দেখায়। প্রযুক্তিগত কারণে হয়তো এক নম্বরে একবারের বেশি টাকা যাবেনা, কিন্তু এই যে কাজটা করার সাহস দেখানো, সেটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নাই। যেসব ধনাঢ্য ও স্বচ্ছল ব্যাক্তি এই সহায়তা পেতে তালিকায় নাম ঢুকিয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে তাদের সংখ্যা হয়ত বেশি নয়। এদের ছবিসহ পরিচয় প্রকাশ করে দেয়াই হবে বড় শাস্তি হতে পারে বলে তাদের অভিমত।(চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com