প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩৩

  |  ১৫:২৪, জুলাই ১৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

লন্ডনে আমার কর্মস্থল সুরমা পত্রিকা অফিস তখন ছিল একটা মিলনকেন্দ্র

:: মো. রহমত আলী ::

যুক্তরাজ্যে যে কয়েকটি বাংলা পত্রিকা বিভিন্ন সময় পাঠক প্রিয়তা লাভ করে তার মধ্যে সাপ্তাহিক সুরমা অন্যতম। এ পত্রিকাটি ১৯৭৮ সালের মে মাসের ২০ তারিখ আত্মপ্রকাশ করে। তখন বৃটেনে বর্ণবাদ ছিল তুঙ্গে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, ডা. বশির আহমদ। আর এর বিভিন্ন দূর্যোগের কান্ডারী ছিলেন তার সহধর্মিনী আয়েশা আহমদ। বিভিন্ন সময় এর সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের পুত্র তোফায়েল আহমদ, সারজামিন আহমদ। তবে অন্য এক পুত্র সারওয়ার আহমদ বৃটেনে এশিয়ানদের অন্যতম মূখপত্র ইংরেজী পত্রিকা ‘ইস্টার্ণ আই’ এর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন অনেকদিন। তাদের উদ্যোগে আরও কয়েকটি পত্রিকা বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়।
এ পত্রিকার সাথে আমার সম্পৃক্ততা ছিল অনেকটা অলৌকিক ব্যাপার। আমি তখন দেশে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত এবং আমার নিজ জেলা সিলেটের বিশ^নাথ প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এ প্রেসক্লাবটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। হঠাৎ একদিন কোন এক পত্রিকার সংবাদে জানতে পারলাম যে, লন্ডনের সুরমা পত্রিকার সম্পাদক মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন আমরা তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে তাৎক্ষনিকভাবে বিশ^নাথ প্রেসক্লাবের উদ্যোগে একটি শোক সভার আয়োজন করি। এতে বিশ^নাথ উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান, নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আরো অনেকে যোগদান করেন। এরপর এ সংবাদটি সুরমা পত্রিকায় পাঠিয়ে দেই। আমার এক ছোট ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল খালিক কালামের মাধ্যমে পাঠানো এ সংবাদটি যথাসময়ে ছাপা হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত সুরমার কারো সাথে আমার তেমন জানা-শোনা ছিল না।
একসময় আব্দুল খালিক কালামের আপন বড় ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল আহাদ দেশে যান। তার মাধ্যমে জানতে পারি যে, পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, নজরুল ইসলাম বাসন। বাসন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় সিলেটে কলেজ লেখাপড়া করার সময় থেকেই। তখন তিনি একটি রাজণৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে এবং আমি অন্য একটি রাজণৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। সেটা ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। আব্দুল আহাদ ভাই তখন সুরমা পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তাই তিনি ও আমি তখন দেশ থেকে সুরমায় প্রকাশের জন্য কিছু সংবাদ পাঠাই। এগুলি গুরুত্বসহকারে ছাপা হতো। আমার স্মরণ আছে ‘সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছয়ফুল এখন নৌকার মাঝি’ এ শিরোনামে একটি সংবাদ পাঠিয়েছিলাম। যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।

আমি যুক্তরাজ্যে চলে আসার পর সুরমা পত্রিকায় সবার সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ঘটে। বেলাল ভাই, এমাদ ভাই, আয়েশা আপাসহ অন্যান্যদের সাথে আমি অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। আর তখন থেকে সুরমায় ‘গ্রাম বাংলায় লন্ডন’ নামে প্রতি সপ্তাহে একটি কলাম অব্যাহতভাবে লিখতে থাকি। এ অবস্থায় একসময় বাসনভাই দেশে বেড়াতে গেলে কয়েক সপ্তাহের জন্য সেখানে তার অবর্তমানে কাজ করি। এরপর বাসন ভাই স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মিডিয়া অফিসার হিসাবে চাকুরি পেয়ে চলে গেলে আমি সুরমায় স্থায়ীভাবে চাকুরী লাভ করি।
আমি দেশে যে পেশায় ছিলাম সে পেশায় চাকুরী পাওয়ায় আমার কাজের গতি তখন দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই সমসাময়িককালে বেশ কয়েকটি সংবাদ সুরমা পত্রিকায় তুলে ধরি যা খুবই আলোচিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ব্রিটিশ বাঙালী এমপি হওয়া সম্পর্কিত তিন পৃষ্টা ব্যাপী স্বাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংবাদ, মালদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের মেয়ের সাথে বাংলাদেশী ছেলে সুয়াইব শাহ’র বিয়ের প্রতিবেদন, ব্রিকলেন বাংলা টাউন ঘোষনার খবর ইত্যাদি।
তখন আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি ছিলেন, তৎকালীন বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও বর্তমানে মানব জমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি প্রতি সপ্তাহের বুধবারে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পাঠাতেন যা ছিল সে সময়ে এক্সক্লোসিভ। সালমা সেলিম প্রতি সপ্তাহ পূর্ণ পৃষ্ঠাব্যাপি মেট্রোমনিয়্যাল জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরমূলক বিষয়ে লিখতেন। তোফায়েল তালুকদার আইন বিষয়ক প্রশ্নের জবাব দিতেন। মাহবুবুর রহমান ও ফকির ইলিয়াস আমেরিকা থেকে লিখতেন। সিলেট থেকে প্রয়াত সাংবাদিক মহিউদ্দিন শিরু ভাই বিশেষ বিশেষ লেখা ও সংবাদ পাঠাতেন। ম. খন্দকার রম্য কথা তুলে ধরতেন। সুয়েব ভাইসহ আরো অনেকে কলাম লিখতেন। নেসওয়ার ভাই কাজের ফাঁকে এসে বসে থাকতেন। দেশ থেকে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ও সরকারী কর্মকর্তাগণ যুক্তরাজ্যে বেড়াতে আসলে এখানে আসতেন। মোটকথা, একটা মিলন কেন্দ্র হিসাবে ছিল তখন সুরমা পত্রিকার অফিস।

সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকা ছাড়াও সাপ্তাহিক জনমত ও নতুন দিন অফিসে এভাবে মিলন মেলা হতো। আমরা কাজ শেষে প্রায় সময়ই আড্ডায় মিলিত হতাম। মুহিব ভাই, নাহাস ভাই, সামাদ ভাই, নবাব ভাই, মুসলেহ ভাই, ইসহাক ভাই, ময়েজ ভাই, তাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানাতেন। তিন পত্রিকা থেকে আমরা তিনজন এবং মাঝে মাঝে সানরাইজ রেডিও থেকে মিসবাহ ভাই ছিলেন তৎকালীন সময়ে কোন সাংবাদ সম্মেলনের প্রাণ পুরুষ। আমাদেরকে তখন খুবই সমাদর করা হতো এবং কখনও কখনও গাড়ি দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হতো।
সুরমা পত্রিকা থেকে একসময় বিদায় নিয়ে চলে আসি আমার নিজস্ব ভ‚বনে। যা বিগত বিশ বছর থেকে দর্পণ ম্যাগাজিনের অফিস হিসাবে চালিয়ে আসছি। বর্তমানে আমার অফিসের পাশেই নব প্রতিষ্ঠিত লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের অফিস। যেখানে সব সময় সংবাদ সম্মেলনসহ নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সে সুবাধে আমার অফিসেও সমাগম আরো বেশী হয়।
সুরমা অফিসের মত দর্পণ অফিসও মিলনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা স্থবির। এ অফিসে বিভিন্ন সময় সভা সমাবেশে যোগদান করেছেন, একুশের গানের লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সাবেক স্পিকার ও হাইকমিশনার শেখ রাজ্জাক আলী, হাইকমিশনার গিয়াস উদ্দিন, হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষাবিধ আব্দুল আজিজ, বৃটেনের সাবেক শ্যাডো হোম মিনিষ্টার ডানকান স্মীথ, এমপি রুশনারা আলী, আপসানা বেগম, এডভোকেট মনজিল মোরসেদ, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, পীর হাবিবুর রহমান, ফেরদৌস আহমদ কোরেশি, তুসার আব্দুল্লা, সাংবাদিক টিপু সুলতানসহ সিলেটের শীর্ষ পর্যায়ের সাংবাদিকগন। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com