সিলেটের গাছবাড়ীতে প্রথমবার পহেলা বৈশাখ পালনের স্মৃতি
:: ইমদাদুর রহমান ইমদাদ ::
স্মৃতি স্বপ্নের মতো। স্মৃতি সুখ ও দুঃখের হতে পারে। মানুষ তার জীবনের কোন স্মৃতিই ভুলে যায় না। তাই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে। গতিময় জীবনে সামনে ক্রমাগত এগিয়ে চলার সময় পিছনে ফিরে থাকাতে ভালো লাগে। ভালো লাগে অতিতের স্মৃতিচারন করতে। অতিতের ঘটনাগুলো স্মৃতিপটে জাগ্রত হলে যে আনন্দের সঞ্চার হয় তা মধুময়। এ স্মৃতি যেন রঙিন স্বপ্নের মতো।
আমার জীবনে তেমনি একটি আনন্দঘন স্মৃতি হচ্ছে সিলেটের কানাইঘাট উপাজেলার গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রথমবারের মতো বর্ষ বরনের সেই দিনভর অনুষ্ঠানটি। জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবো, আলোক ঝরণা ধারার মতো সেই স্মৃতি আমার জীবনে উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে থাকবে। আর সেই ইতিহাসের স্মৃতিগুলো বিনে সুতোর মালার মতো আগামী প্রজন্মের ও স্হানীয় সুশীল সমাজ কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত লালন ও ধারণ করবেন।
গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর সেই স্মৃতি হচ্ছে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের উৎসবে অংশগ্রহণ এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। যাহা ছিলো আমার জীবনেরও প্রথম পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান উপভোগ করা।
সেই দিনটি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ। পহেলা বৈশাখ ১৪১৮ বাংলা, রোজ বৃহস্পতিবার। শীতের জীর্ণ ঝরা গৈরিক বসন পরিহার করে প্রকৃতি যখন নবরূপে সজ্জিত। আকাশে মেঘের খেলা। গাছে গাছে গজায় পাতা। কাননে ফুল ফুটে। কোকিলের কুহু কুহু শব্দে জমে উঠে প্রাণ। দক্ষিনের হাওয়া আম্রকানন মুকুলের গন্ধ। প্রকৃতি যখন নতুন সাজে রুপধারণ করে। তখনি শুরু হয় বাঙালীর চিরাচরিত বর্ষবরণ উৎসব। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) গাছবাড়ী স্টাডি সেন্টারের উদ্দোগে গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমী।
ঐদিন ভোর থেকে “এসো হে বৈশাখ ” স্লোগানে নবীন-প্রবীন ছাত্র/ ছাত্রীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসতে থাকেন। প্রথম বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দিতে এলাকার তরুণ, তরুণীসহ সব পেশার মানুষ।
বাঙালীর চিরচেনা নকশী কাঁথার নানান ডিজাইনের রকমারি বাংলা ফ্যাশনের পোশাক পরে, হৈ হুল্লোড় করে বর্ষবরণের দিনটি উদযাপন করতে আসেন । নানান ঘাত- প্রতিঘাত, বাধা, প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই প্রথমবার বর্ষবরণ উৎসব করার পিছনে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশী তাঁরা হলেন বাউবির সমন্বয়কারী আব্দুল হক, সমাজসেবী অলিউর রহমান এবং সাংবাদিক দেলওয়ার হোসেন সেলিম। এসব গুণীজনদের নিরন্ত প্রচেষ্টায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা গাছবাড়ী এলাকায় প্রথম বারের মতো বর্ষবরণ উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ, সফলভাবে অনুষ্টিত হয়েছিল।
বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সকাল ১০টায় শুরু হয় বর্ণাঢ্য র্যালী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পান্তা ইলিশ খাওয়ার উৎসব ও আলোচনা সভা। দিনব্যাপি এই বর্ষবরণ উৎসব উপলক্ষে বিদ্যালয় সেদিন সেজেছিল এক নতুন সাজে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও বিনোদন প্রিয়দের অন্তরে ছিল আনন্দের ঢেউ। বর্ষবরণ উপলক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। খেলাধুলার মনোমুগ্ধকর আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা উপচে পড়া দর্শক শ্রোতাদের আনন্দ, চিত্ত বিনোদনের খোরাক জোগায়।
বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ, আলোচনা সভা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিবাবক এবং অতিথিদের নিয়ে যৌথ র্যালী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বর্নাঢ্য এই অনুষ্টানমালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্হিত থেকে আমাদেরকে উৎসাহ প্রদান করেন কানাইঘাট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি, সাংবাদিক দেলওয়ার হোসেন সেলিম। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাজনীতিবীদ ওলিউর রহমানের সভাপতিত্বে এবং গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর সহকারী শিক্ষক আবু হানিফের পরিচালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলহাজ্ব বশির আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন, লন্ডন প্রবাসী এডভোকেট আব্দুছ ছাত্তার, গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর সিনিয়র সহকারী শিক্ষক এবাদুর রহমান, সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ, সহকারী প্রধান শিক্ষক ভানুরাম বৈধ্য (বাবু), শিক্ষক জাহাগীর আলম, শিক্ষক আব্দুল মতিন, মরহুম শিক্ষক আব্দুল মজিদ, গাছবাড়ী ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক আল আমীন, কবি হাসান চিশতী, সমাজসেবী আহমদ হোসেন, গাছবাড়ী বাজার ব্যাবসায়ী সমিতির সদস্য প্রয়াত শ্রী শ্যামল চন্দ চন্দ্র, এমাদ উদ্দিন প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) এর গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমী শাখার প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হক। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন তাহসিনা আক্তার শাপলা, মিনহাজ উদ্দিন নয়ন, চয়ন, ইকবাল আহমদ রাজু, সুয়াইব, শাহীন আহমদ ফারজান। একে একে করে বক্তৃতার পালা শেষে মঞ্চে আসনরত প্রধান অতিথি সাংবাদিক দেলওয়ার হোসেন সেলিমকে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানালেন অনুষ্ঠানের উপস্হাপক। প্রধান অতিথি মাইক হাতে নিয়ে তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বক্তৃতা শুরু করলে দর্শক সারিতে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। মুহুরমুহুর করতালীর মধ্য দিয়ে প্রধান অতিথি সকলকে বাংলা নব বর্ষের শুভেচ্ছা জানান। তিনি পহেলা বৈশাখের ইতিহাস ও ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, ঐতিহ্যবাহী আমাদের এই প্রতিষ্টানে আজ অনেক দিনের প্রত্যাশার অবসান ঘটিয়ে প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। এটি খুবই আনন্দের বিষয়। ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি সমন্বয়কারী আব্দুল হক, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অলিউর রহমান সহ সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন ধন্যবাদ জানান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় ক্ষুদে নবীন, প্রবীণ অনেক শিল্পীরা গান গেয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে মাতিয়ে রাখেন। তারা হলেন সৌদি আরব প্রবাসী মানিক উদ্দিন, রিপন বাবু, ইমদাদুর রহমান ইমদাদ ও আতিকুর রহমান সামাদ। বৈশাখ নিয়ে ছড়া ও কবিতা পাঠ করেন রাবিয়া আক্তার রুবী, তানিয়া আক্তার, আব্দুস সামাদ, ফেরদৌস বেগম, আতিকুর রাহমান, জামাল আহমদ, শাপল বেগম, আশিকুর রহমান প্রমুখ। গানে মুগ্ধ হয়ে প্রধান অতিথি শিল্পীদের বিশেষ পুরস্কৃত করেন। আমিও তিনির হাত থেকে বিশেষ পুরস্কার লাভ করেছিলাম।
উল্লেখ্য, আমাদের এলাকার কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট সাংবাদিক দেলওয়ার হোসেন সেলিম বর্তমানে ফ্রান্সে স্হায়ীভাবে বসবাস করছেন। সুদুর প্রবাসে থেকেও তিনি মা, মাটি, মানুষকে ভুলে যাননি। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু ও নিরাপদ জীবন কামনা করি। একজন নিঃস্বার্থ পরোপকারি আদর্শ মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
মহাকালের গর্বে অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েও সৃষ্টি হয় নতুন অমর অক্ষয় ইতিহাস। মানুষ অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করতে পারে না। আমার বিশ্বাস অত্রাঞ্চলের প্রগতিশীল মানুষগুলো সেই ধারাবাহীকতা অনুসরণ করে এগিয়ে যাবেন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশে এবং বাঙালীর চিরাচরিত নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্ষবরনণের সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ধন্যবাদ জানাই আমার এলাকার অগণিত সংস্কৃতি প্রেমিক দর্শক শ্রোতা মন্ডলীদের, সেদিন তাঁরা দিনভর ধৈর্য ও সৌর্যের পরিচয় দিয়ে আমাদেরকে ঋণী করার জন্য।
লেখক : রোটার্যাক্টর ইমদাদুর রহমান ইমদাদ, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট ছাত্র ও যুব কল্যাণ ফেডারেশন।