জনমনে নানা প্রশ্ন : উত্তর মিলছে না ফাহিম হত্যা
মোঃ নাসির, নিউ জার্সি, আমেরিকা থেকে :
প্রবাসে নতুন প্রজন্ম এবং প্রবাস কম্যুনিটির গর্ব বাংলাদেশী বংশোদ্ভ‚ত আমেরিকান পাঠাও’র কো-ফাউন্ডার ফাহিম সালেহ’র খুনের জট এখনো পুরোপুরি খুলেনি। উত্তর মেলেনি এখনো অনেক প্রশ্নের। আর এই রহস্য সৃষ্টি করেছেন ফাহিম সালেহকে খুনের অভিযোগ গ্রেফতার টাইরেস ডেভো হ্যাসপিলের আইনজীবী রবাটার্স। তিনি আদালতকে বলেছেন, আমরা সত্য উদঘাটনের প্রারম্ভীক অবস্থার খুব কাছাকাছি আসি। এই মামলাটি জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। এই মামলা একজনের গ্রেফতার বা অভিযোগের চেয়ে আরো বিসৃস্ত। এ ছাড়াও তিনি তার মক্কেলকে নির্দেষ দাবি করেন। ফাহিম সালেহ’র খুনের মামলাটি আমেরিকায় হাই প্রোপাইন খুনের মামলা। অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, ঘটনাটিকে যত সহজভাবে দেখা হচ্ছে আসলে তা এত সহজ নয়। বেশ কিছু প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম শুধু কী অর্থের জন্যই ফাহিমকে খুন করা হলো? মাত্র ১৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ফাহিম কীভাবে তার সহকারি হিসাবে নিয়োগ দিলেন? খুনর দায়ে গ্রেফতারকৃত হ্যাসপিল কীভাবে ফাহিমের বাসায় প্রবেশ করে? নিউইয়র্ক সিটির পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী হ্যাসপিল দুই দিনে দুই বার ফাহিমের বাসায় ঢুকেছে। একবার খুনের দিন ১৩ জুলাই এবং খুনের পরের দিন ১৪ জুলাই। ২.৫ মিলিয়ন ডলারের ঐ লাক্সজারি এ্যাপর্টমেন্টের সিকিউরিটি হ্যাসপিল ভেদ করলো কী ভাবে? পালিয়েই বা গেল কীভাবে? একজন খুনি খুন করার পর যাকে খুন করেছে তার কার্ডই ব্যবহার করবে কেন? ফাহিমের পরিবারও কেন পুলিশের উপর দায় চাপিয়ে বলছে, তারা কেনো মিডিয়ার সাথে কথা বলতে পারবেন না? বা কথা বলছে না। এমন কি জানাজায় যাবার জন্যও বারণ করেছে। এত লুকোচুরি কেন? মিডিয়াকে এড়ানোর কারণ কী? তারা কী মিডিয়াকে এড়িয়ে থাকতে পারবেন? ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইল একটি ছবি প্রকাশ করেছে। খুনের দায়ের গ্রেফতার হাওয়া হ্যাসপিল খুনের পরেই এক তরুণীকে নিয়ে ম্যানহাটনে হাঁটছেন। যদিও ঐ নারীর মুখটি ঢেকে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন তুলেছেন- হ্যাসপিলের সাথে ঐ যুবতীটি কে? কেনইবা ঐ তরুণীকে রহস্যময় বলা হচ্ছে?
জানাজা এবং দাফন
ফাহিম সালেহ’র নামাজে জানাজা গত ১৯ জুলাই দুপুর ১২টায় নিউইয়র্কের পোকেস্পীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাজার পূর্বে একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকাত্ম বাবা সালেহ আহমেদ শুধু বললেন, ‘আপনারা ওর জন্যে দোয়া করবেন। ওর আত্মা যেন শান্তিতে থাকে’। তিনি আরো বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে, নিশ্চয়ই সুবিচার পাবো।’ ১৯ জুলাই রবিবার দুপুরে নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৬৫ মাইল দূরে অরেঞ্জ কাউন্টির নিউ উইন্ডসোর সিটির প্লিজেন্ট হীল রোডে ‘নূর মিড হাডসন সিমেট্রি’তে ফাহিমকে দাফনের আগে একইস্থানে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। করোনার কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে সকলের প্রতি অনুরোধ সত্তে¡ও আশপাশের বিপুলসংখ্যক মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। জানাজায় ইমামতি করেন আল নূর মসজিদের ইমাম মাওলানা ওসমানী। জানাজা শেষে সেখানেই ফাহিম সালেহকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। ফাহিমের বাবা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার সালেহ আহমেদ আইবিএম এর উপদেষ্টা-প্রকৌশলী হিসেবে কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। পরিবার নিয়ে বাস করছেন এই অরেঞ্জ কাউন্টি সংলগ্ন পোকেস্পীতে। যে কারণে ফাহিমকে সেখানে কবরস্থ করা হয়।
কোর্টে হ্যাসপিল এবং অভিযোগ গঠন
পাঠাও-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী হ্যাসপিলকে গত ১৭ জুলাই কোর্টে তোলা হয়। সেই সময় হ্যাসপিলকে দোষী প্রমাণের জন্য ‘পর্যাপ্ত আলামত’ পাওয়া গেছে। নজরদারি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ দেখে এসব আলামত শনাক্ত করা হয়েছে। ১৭ জুলাই মধ্যরাতে ম্যানহাটনের ক্রিমিনাল কোর্টে হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় প্রসিকিউটররা এসব কথা বলেন। তারা বলেন , ১৪ জুলাই নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফাহিম সালেহ’র ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৭ জুলাই এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী হ্যাসপিলকে। একইদিনে তার বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের অভিযোগ দায়ের করা হয়। সে সময় ম্যানহাটনের অ্যাসিসট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি লিন্ডা ফোর্ড বলেন, ভিডিওতে হ্যাসপিলকে একটি হোম ডিপো থেকে করাত ও পরিষ্কার করার উপকরণ কিনতে দেখা গেছে। ১৪ জুলাই মঙ্গলবার ঘটনাস্থল থেকে সে উপকরণগুলোই সংগ্রহ করা হয়েছে। নজরদারি ক্যামেরা ফুটেজে হত্যাকারীর গায়ে যেমন পোশাক ছিল সেরকমই পোশাক হ্যাসপিলের ব্রুকলীনের বাসায় পাওয়া গিয়েছে। আবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাসপিলকে ঘটনাস্থলে শনাক্ত করতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। লিন্ডা ফোর্ড বলেন, ‘এ মামলার ক্ষেত্রে বিস্তর প্রমাণ রয়েছে। অপরাধ সংঘটনের আগে ও পরে তাকে নজরদারি ক্যামেরায় দেখা গেছে। ভিডিও টেপ দেখে অন্তত দুইজন ব্যক্তি তাকে শনাক্ত করতে পেরেছে।’ ফোর্ড আরো বলেন, ১৩ জুলাই দুপুর প্রায় পৌনে দুইটার দিকে লিফট-এ করে ফাহিমের পিছু নেয় মাস্ক পরিহিত হ্যাসপিল। লিফটটি ফাহিমের ফ্ল্যাটে পৌঁছানোর পর পরই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয় এবং তার কাঁধ ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর মরদেহ অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে রেখে সেখান থেকে চলে যায় হ্যাসপিল। পরদিন হোম ডিপো থেকে করাত ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে আবারও ওই অ্যাপার্টমেন্টে যায় হ্যাসপিল। অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, ফাহিমের মরদেহ টুকরো করা শেষে সেগুলো ব্যাগে ভরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল হ্যাসপিলের। তবে তার আগেই ফাহিমের খালাতো বোন এসে কলিংবেল চাপতে থাকলে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায় হ্যাসপিল।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনা সম্পর্কে অবগত ৩ জন কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন, ফাহিমের কাছ থেকে আগে ৯০ হাজার ডলার চুরি করেছিল হ্যাসপিল। ফাহিম তখন তাকে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে কোন পুলিশি এ্যাকশন নেননি ফাহিম। হ্যাসপিল যেন কিস্তিতে অর্থ ফেরত দিতে পারে, তার পথ বাতলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে পুলিশ সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, গোয়েন্দারা ফাহিমের ফোনে পাওয়া একটা টেক্সট মেসেজে ঐ অর্থ চুরির ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর হ্যাসপিলের ওপর নজরদারি শুরু করে।
আদালত হ্যাসপিলকে জামিন দেয়নি
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরিস হ্যাসপিলকে জামিন দেননি আদালত। গত ১৮ জুলাই শনিবার বিচারক জোনাথন স্ভেটকি তাকে জামিন ছাড়াই হাজতে রাখা এবং ১৭ আগস্ট আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
নিউ ইয়র্ক সময় ১৭ জুলাই মধ্যরাতে ম্যানহাটনের ক্রিমিনাল কোর্টে হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় ম্যানহাটনের অ্যাসিসট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি লিন্ডা ফোর্ড জানান, টাইরিস হ্যাসপিলকে দোষী প্রমাণের জন্য ‘পর্যাপ্ত আলামত’ পাওয়া গেছে। নজরদারি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ দেখে এসব আলামত শনাক্ত করা হয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের প্রধান ডিটেকটিভ রোডনি হ্যারিসন সাংবাদিকদের বলেন, ফাহিমের অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তদারকি করতো সন্দেহভাজন হ্যাসপিল। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২১ বছর বয়সী হ্যাসপিল ফাহিমের ১ লাখ ডলার চুরি করেছিল। এর বাইরেও ফাহিম তার কাছে আরও অনেক ডলার পেতেন। প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, হ্যাসপিল হত্যাকান্ডকে এমনভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন যাতে মনে হয় এটি কোনও পেশাদার খুনির কাজ এবং আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রয়েছে। তবে তার বেশ কিছু ভুলের কারণে পুলিশ তাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
গোয়েন্দাদের ধারণা, ১৬ বছর থেকে ফাহিমের সঙ্গে কাজ শুরু করে হ্যাসপিল এবং ধীরে ধীরে ফাহিমের আর্থিক ও ব্যক্তিগত বিষয় দেখাশোনা শুরু করে। ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে নিহতের কুকুরের দেখাশোনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফাহিম তাকে যথেষ্ট পরিমাণ মজুরি দিতেন। যার ফলে হ্যাসপিল তার পরিবারের অনেকের ঋণ শোধ করতে পেরেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হ্যাসপিল লং আইসল্যান্ড হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন। তবে ডেইলি নিউজ বলছে, সেই গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেনি হ্যাসপিল। ফাহিমের সঙ্গে তিনি কাজ করার সুযোগ পায় একটি প্রতিযোগিতা থেকে।
ফাহিমকে হত্যার পর হ্যাসপিলের পার্টি করার পরিকল্পনা
এদিকে ফাহিম সালেহর হত্যায় জড়িত ২১ বছরের তরুণ হ্যাসপিল সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। ফাহিম সালেহকে হত্যার দুদিন পরই পার্টি করার জন্য বেলুন কিনেছেন হ্যাসপিল। নিউইয়র্ক পুলিশের কাছে আসা ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, ইস্ট হাউস্টন স্ট্রিটের প্রায় এক মাইলের কম দূরত্বের ক্রসবি স্ট্রিটের একটি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে তিনি বেলুন ধরে আছেন। তাঁর সঙ্গে একজন নারীকেও দেখা গেছে। বড় আকারের পার্টি বেলুনটি কিনতে ফাহিম সালেহর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। ব্রুকলিনে বসবাস করা হ্যাসপিল এয়ারবিএনবি থেকে ক্রসবি স্ট্রিটের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কয়েক দিনের জন্য ভাড়া করেন। হ্যাসপিল যখন পার্টি বেলুন কেনাকাটা করছেন, অদূরেই নিউইয়র্ক পুলিশ ফাহিম সালেহর খুনিকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল।
নিউইয়র্ক পোস্টকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা হ্যাসপিলকে ‘নিউ আমেরিকান সাইকো (মনোবিকারী)’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফাহিম সালেহকে হত্যার পরও তাঁর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছিলেন হ্যাসপিল। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে উবার পরিবহনের ভাড়া মিটিয়েছেন হোম ডিপোট নামের দোকানে ইলেকট্রিক করাত কেনার জন্য যাওয়া- আসার সময়। ক্রেডিট কার্ডের সূত্র ধরেই পুলিশ তাঁকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ১৭ জুলাই সকালে ক্রসবি স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
হ্যাসপিলের সাথে কে এই রহস্যময় তরুণী
বাংলাদেশি-আমেরিকান তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ খুনের দায়ে তার ব্যক্তিগত সহকারী হ্যাসপিলকে নিউইয়র্কের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এরই মধ্যে খুনে অভিযুক্ত হ্যাসপিলের সাথে থাকা এক তরুণীকে নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডনের ডেইলি মেইল ওই তরুণীকে ‘রহস্যময়ী’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
হত্যাকান্ডের পর ১৫ জুলাই দুপুরে সেই তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ক্রসবি স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অভিযুক্ত খুনিকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। সিসি ক্যামেরার সেই ভিডিও উদ্ধার করেছে পুলিশ। গোয়েন্দারা বলছেন, ১৩ জুলাই দুপুরের পর ম্যানহাটনে নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে খুন হন ফাহিম সালেহ। খুন করে হত্যাকারী ওই দিন চলে যায়। পরদিন আবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে সে। এরপর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ফাহিম সালেহের মরদেহ কয়েক টুকরা করে সেগুলো ব্যাগে ভরে। রক্ত মুছে ফেলারও চেষ্টা করে। এরপর ফাহিম সালেহের ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেভন হ্যাসপিলকে (২১) গ্রেফতার করে নিউইয়র্ক পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে এই আসামির নতুন বাসার দূরত্ব এক মাইলেরও কম। যেখানে ওই তরুণীকে দেখা যায়।
সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যায়, টি-শার্ট পরা হ্যাসপিলের বামপাশে সমান তালে হাঁটছেন ওই তরুণী। তার পরনের পোশাক কালো। আসামি হ্যাসপিলের মূলত বসবাস ব্রæকলিনের প্রসপেক্ট পার্কে। কিন্তু তিনি আত্মগোপন করে ম্যানহাটনের ক্রসবি স্ট্রিটের একটি এপার্টমেন্টে ছিলেন। অল্প সময়ের জন্য সে এটা ভাড়া নিয়েছিলো বলে মনে করা হচ্ছে
ডেইলি মেইলের হাতে আসা ভিডিও সম্পর্কে বলা হয়, এটা এক্সক্লুসিভ ভিডিও। এতে ১৫ জুলাই স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ওই তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে হ্যাসপিলকে ক্রসবি স্ট্রিটে দেখা যায়। এ ঘটনায় তরুণীকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানায় নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।
৩৩ বছরের ফাহিম সালেহ ১৫ বছরই ছিলেন উদ্যোক্তা
কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস ফাহিম সালেহ স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ করেন তিনি। ফাহিম সালেহর লিঙ্কডইন প্রোফাইল বলছে, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রযুক্তি উদ্যোগের উদাহরণ টানতে গেলে সবার আগে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ার কোম্পানি পাঠাওয়ের নাম আসে। বিশ্বজুড়ে এ কোম্পানি বেশ পরিচিতিও পেয়েছে। এরই সহ-উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ নিউইয়র্কে বীভৎস হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। ফাহিম সালেহর জন্ম সৌদি আরবে। এরপর পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউইয়র্কে চলে আসেন। পড়াশোনা করেছেন নিউইয়র্কে। মেধাবী ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাইস্কুলে পড়া অবস্থাতেই উইজ টিন নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন। এরপর ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর শেষ করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে কিংবা কোনো কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে যান। ২০০৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে ফাহিম ঢাকায় হ্যাকহাউস নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা খুব একটা সফলতা পায়নি। চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় গিয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে পাঠাও উদ্যোগ সফল হয়েছিল। শুরুতে পণ্য পরিবহন সার্ভিস থাকলেও পরবর্তী সময়ে রাইড শেয়ারিং সেবাও চালু করে পাঠাও। বাংলাদেশে সফল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুসেইন এম ইলিয়াস, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিফাত আদনান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি ইউনিভার্সিটির ফাহিম সালেহ। ইলিয়াস পাঠাও যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘২০১৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানীতে প্রথমে অন-ডিমান্ড ডেলিভারি সেবা হিসেবে পাঠাও প্রতিষ্ঠা করি। পরে এক বিনিয়োগকারী দেখান মোটর সাইকেল- ট্যাক্সির সম্ভাবনা। একই সেবা ইন্দোনেশিয়াতে শুরু করে সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন ওই বিনিয়োগকারী। ফলে পাঠাও সেবাকে নতুনভাবে ওই আঙ্গিকে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিই আমরা। বাংলাদেশিরা মোটরসাইকেল -ট্যাক্সির বিষয়টিকে ঠিক কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিশ্চিত ছিলাম না। শুরুতে কিছুটা সময় নিয়েছিল মানুষ। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের মোটর সাইকেলের পেছনে বসতে একটু সময় লেগেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। ১০০টি মোটরসাইকেল আর ১০০ জন চালক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাঠাওয়ের সফলতার পর ফাহিম সালেহ তাঁর কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যান। এরপর তিনি পাঠাওয়ের আদলে অন্য দেশে ব্যবসার চিন্তা করেন। বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পাঠাও প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফাহিম সালেহ চেয়েছিলেন আফ্রিকা মহাদেশে ব্যবসা বিস্তার করতে। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নাইজেরিয়ায় গোকাডা নামে একটি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করেন। তার সঙ্গে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আরও একজন ছিলেন। সালেহর মালিকানাধীন গোকাডা সার্ভিস ডেলিভারিতে এক হাজার মোটরসাইকেল রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই সংকটে পড়ে তারা। কারণ, নাইজেরিয়ার সরকার মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং নিষিদ্ধ করে।
টেককাবাল নামে নাইজেরিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই গোকাডা ৫৩ লাখ ডলার আয় করে। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গোকাডা পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে। বর্তমানে নাইজেরিয়ার রাজধানী লেগোসে তাদের ১০০০ মোটরসাইকেল রয়েছে। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইনের খবরে ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়ার প্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে নাইজেরিয়ার গোকাডার পাশাপাশি পিকআপ নামে কলম্বিয়ার আরেকটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিরও তিনি অংশীদার। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গোকাডা বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়লে গত বছরের শেষ দিকে ফাহিম কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরনের ব্যবসায় তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।
কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস তাঁর স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। ২০১৭ সালে গোকাডা চালুর পর গত বছরের জুনে ৫৩ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি সেবা আরো বাড়াতে চেয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে আরো তহবিল পায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার এ সেবা বন্ধ করে দেয়। তাঁর লিঙ্কডইন প্রোফাইলে দেখা যায়, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিনিয়োগ করেন তিনি।
তবে ১৪ জুলাই মঙ্গলবারের ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। ২৫ কোটি ডলারের বিলাসবহুল বাড়িতে কড়া নিরাপত্তায় তাঁর বীভৎস্য খুনের ঘটনা সবাইকে ধাক্কা দিয়েছে। সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন। সালেহ নিজেও কোনো সময় বিপদ সম্পর্কে কোনো সূত্র দেননি। গত জুনে তিনি টুইট করেন, ২০২০ সাল ভালো অনুভব করছি। তিনি একটি গোকাডা বাইক ক্লাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন।
তাঁর বন্ধুদের মতে, সাধারণ জীবনযাত্রা ছিল ফাহিমের। তিনি প্রতিদিন সকালে দৌড়াতেন। মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। প্রযুক্তি গ্যাজেট সংগ্রহ করতেন। এবং ছোট কুকুর লাইলাকে নিয়ে থাকতেন। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট সাধারণত উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিগত-প্রবণতা বা ব্র্যান্ড সম্পর্কে ছিল।
সালেহর বন্ধু পাঠাওয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট কিশোয়ার হাশমি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাকে প্রথম দেখেছিলাম পাঠাওয়ের লাল টিশার্টে । চালকদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন। টিমকে তাদের জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছেন।’ পাঠাও এক বিবৃতিতে বলেছে, ফাহিম বাংলাদেশে এবং এর বাইরেও প্রযুক্তি বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বাস করেছিলেন।
নিউইয়র্কে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হওয়া ফাহিম সালেহ নিজের সম্পর্কে ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন অন্ট্রেপ্রেনিওর, ইনভেস্টর, ড্রিমার অর্থাৎ উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, স্বপ্নবাজ। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী হুসেইন এম ইলিয়াস বলছিলেন যে সত্যিকার অর্থেই একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন ফাহিম সালেহ। ফাহিম কখনো এক জায়গায় আটকে থাকতেন না। এজন্যই একটার পর একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনটায় সফল হয়েছেন, আবার কোনটায় হননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।
ফাহিম সালেহ বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান হলেও বাংলাদেশে খুব একটা থাকেননি। ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমেরিকার গণমাধ্যম তাকে চিহ্নিত করেছে ’টেক মিলিওনিয়ার’ হিসেবে। ’খুব অল্প বয়সেই কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ১৫/১৬ বছর থেকে আমেরিকাতেই কাজ শুরু করেন আইটি ফিল্ডেই। ফলে ২০১৪ সালে যখন ঢাকায় যান, তার আগেই প্রযুক্তির বিশ্বে তিনি পরিচিত ব্যক্তি, এবং সেটা তার কাজের জন্যই।’
পাঠাও প্রতিষ্ঠার আগেই ফাহিম সালেহ ঢাকায় দু’টি প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিলো হ্যাকহাউজ, অফিস ছিলো বনানীতে। এখানেই কাজ করতে এসে হুসেইন ইলিয়াস তার সঙ্গে পরিচিত হন এবং পরবর্তীতে তারা দু’জনসহ মোট তিনজন মিলে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও চালুর কাজ শুরু করেন। আগের দু’টি উদ্যোগে সফল না হলেও ২০১৬ সালের শেষের দিকে চালুর পর পাঠাও দারুণ জনপ্রিয়তা পায় ২০১৭ সালে।
অর্থকে অনুসরণ করোনা, তাকেই তোমাকে অনুসরণ করতে দাও
নিজের ব্লগে ফাহিম সালেহ লিখেছিলেন, ‘ডোন্ট ফলো দা মানি, লেট ইট ফলো ইউ’।
তিনি লিখেন, যখন তিনি প্রথম ইন্টারনেট গেমস শুরু করেছিলেন, তখন তার লক্ষ্য ছিলো খরচ কমানো। ‘কেন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাউকে ভাড়া করবো, যখন আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ আছে! কেন প্রিমিয়াম সার্ভার কিনতে হবে, যেটা আছে সেটাই যখন ভালো কাজ করছে! কেন অফিস নিতে হবে, যখন বাসা থেকেই কাজ করা যাচ্ছে! কিন্তু যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি যে আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করে ফেলেছি।
নিজের প্রথম ওয়েবভেঞ্চার উইজটিন ইনক-এর প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে এটিকে সঠিকভাবে বাড়তে দিলে বিশ্বখ্যাত জিগনা বা স্লাইড-এর মতোই হতো। ২০০৫ সালে বেশ সম্ভাবনামঢ হয়েছিলো অন্তত ১৫টি সাইটের নেটওয়ার্ক উইজটিন ইনক।
যতটা পারো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করো, ঠিক যতটুকু দরকার ততটুকুই বেতন নাও, পরে আরও বিনিয়োগ করো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অর্থকে অনুসরণ করো না, তাকেই তোমাকে অনুসরণ করতে দাও।’
প্রজেক্ট ও বিনিয়োগ
বিভিন্ন দেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কিংবা ওয়েবসাইট নেটওয়ার্কিং ছাড়াও তার ব্লগে যেসব প্রজেক্টের কথা তিনি উল্লেখ করেছন, সেগুলো হলো – প্রাংকডায়াল (এর মাধ্যমে বন্ধুদের কাছে ফানি কল পাঠানো হয়), ডলস্পট (বাচ্চাদের মোবাইল-ভিত্তিক গেমিং সাইট) এবং হ্যাকহাউজ (ঢাকা-ভিত্তিক উদ্যোগ)। আরও বিনিয়োগ ছিল নিনজা ফিস স্টুডিওস-এ। এটি বাচ্চাদের মোবাইল গেমিং কোম্পানি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) বলছে, ফাহিম সালেহ’র মৃত্যুতে দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রি কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাকে হারায়নি, বরং দেশের তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তাগণ হারালো তাদের একজন অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শককে।
পরিবারের বিবৃতি
ফাহিম সালেহর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না করার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে ১৮ জুলাই একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে। এ বিবৃতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে ফাহিম সালেহর প্রতি যে ভালোবাসা এবং এ সময়ে তাঁদের পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। সবার ভালোবাসা পরিবারের কাছে পৌঁছেছে এবং কঠিন এ সময়ে এমন প্রতিক্রিয়া পরিবারকে সাহস জুগিয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা জানি সবাই আমাদের পক্ষ থেকে কিছু জানতে চাচ্ছে। পরিবার এ কঠিন সময়ে এবং দুঃখজনক সাম্প্রতিক ঘটনায় ফাহিম সালেহর পরিবারের সদস্যদের নিজেদের মধ্যে থাকার ইচ্ছাকে সবাই সম্মান দেখাবেন।’ পরিবারের পক্ষ থেকে এনওয়াইপিডির সদস্যদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
ভালবাসায় শিক্ত ফাহিম
শোক আর ভালোবাসায় নিউইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশীরাসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ স্মরণ করছেন মাত্র ৩৩ বছরে সাফল্যে চূড়ায় পৌঁছানো বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণ ফাহিম সালেহকে। বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল ম্যানহাটানের ইস্ট ২৬৫ হাউস্টন স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ফুল আর শোকের বার্তা দিয়ে লোকজন স্মরণ করছেন তাঁকে। ক্ষণজন্মা ফাহিম সালেহ যে ভবনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে শোকে বিহব্বল লোকজন, পশ্চিমা লোকজন শোকের অভিব্যক্তি নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে চোখ ভেজাচ্ছে, কেউবা ফুল দিয়ে সমবেদনা জানিয়ে চলে যাচ্ছেন। তবে বুকের মধ্যে চাপা আত্মনার্ত, শোকের পাথর। এমন নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে? সবাইকে খুনের দায়ের গ্রেফতারকৃত হ্যাসপিলের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। কেউ কেউ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। সেই সাথে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য প্রসাশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ম্যানহাটানে ফাহিমের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন বাংলা চ্যানেলের প্রেসিডেন্ট/সিওও শাহ জে চৌধুরী, কম্যুনিটি এক্টিভিস্ট শুভ রায়, গোপাল স্যান্যাল, মোহাম্মদ আলম প্রমুখ।
সুষ্ঠু বিচার দাবি
ফাহিম সালেহ’র নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রবাসে বাংলাদেশী বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, এই হত্যাকান্ড কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। একটি মানুষ আরেকটি মানুষকে এত নৃংশতভাবে হত্যা করত পারে? তারা আরো বলেন, শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি খুনি, সে ফাহিমের শরীর খন্ডবিখন্ড করেছে। তারা ফাহিমের হত্যাকান্ডের সাথে যে বা যারা জড়িত তাদের সুষ্ঠু এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
ডাইভার্সিটি প্লাজা
ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে ডাইভার্সিটি প্লাজায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন ‘ইউএস বাংলাদেশ কো-অপারেশনের (ইউবকো) প্রেসিডেন্ট জসীম উদ্দিন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইউবকোর উপদেষ্টা হাকিকুল ইসলাম খোকন এবং মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান, ইউবকো সহসভাপতি পলাশ, সাধারণ সম্পাদক আবুল হায়াত, সাংবাদিক তোফাজ্জেল হোসেন লিটন, ইশতিয়াক আহম্মেদ প্রমূখ।
ভার্চুয়াল আলোচনা
গত ১৮ জুলাই রাতে ফাহিমের স্মৃতিচারণ ও আত্মার শান্তি কামনায় আন্তর্জাতিক এক জুম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন লুইজিয়ানা স্টেটের নিউঅর্লিন্স, লাফায়েত, লেক চার্লস, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ওহাইয়ো, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ছাড়াও সাউথ আফ্রিকা, লন্ডন, বাংলাদেশ থেকে পেশাজীবীরা। এ মিটিংয়ে অংশ নেয়া নিউঅর্লিন্সের ডেলাগো কমিউনিটি কলেজের চ্যান্সেলর এবং নিউঅর্লিন্স আঞ্চলিক ট্রানজিট অথরিটির কমিশনার ড. মোস্তফা সারোয়ার জানান, সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে ফাহিমেরা সপরিবারে এখানকার লেকচার্লস এলাকায় ছিলেন বেশ কবছর। সে কারণে অনেকেই ফাহিমের স্মৃতিচারণ করেন এবং তার মতো অসাধারণ উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন একজন উঠতি টেক জায়ান্টকে এধরনের নিষ্ঠুর পরিস্থিতির ভিকটিম হওয়ায় সকলে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন। দুই ঘণ্টার এ মিটিংয়ে ৬০ জনেরও অধিক পেশাজীবী অংশ নেন।
এ দিকে আগামী ২৪ জুলাই সন্ধ্যায় ৭টায় ফাহিম সালেহ’র কুলখালি ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এই দোয়া অনুষ্ঠিত হবে ভার্চুয়াল জুমের মাধ্যমে। আয়োজনে রয়েছেন প্রবাস কম্যুনিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ নাসির আলী খান পল, জুয়েব এবং মিজান চৌধুরী। দোয়া পরিচালনা করবেন মাওলানা কাজী কাইয়্যুম। সহযোগিতায় রয়েছেন বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ এসোসিয়েশন, চিটাগং সমিতি, গ্রেটার নোয়াখালি সোসাইটি। মিটিং আইডি হচ্ছে- ৮২৯ ১৬৮৫ ৪৭৭১, কোর্ড ৬৯৯১৬৭।
১০-১২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মানবন্ধন
ফাহিম হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বসবাসরত এএসসি ও এইচএসসি ২০১০-১২ ব্যাচের প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ হত্যার প্রতিবাদে নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকাতে এই মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
এতে ওই ব্যাচের প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। ১৯ জুলাই রোববার বিকালে নিউ ইয়র্ক শহরের জ্যামাইকাতে এই মানববন্ধনে কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে ফাহিম হত্যার আসল রহস্য উদ্ঘাটন ও শাস্তি দাবি করেন। সেইসঙ্গে মানববন্ধনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা হত্যাকারীর দ্রুত বিচার চেয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির সুরক্ষার দাবি করেন।
মানববন্ধনে অংশ নেয়া সোনিয়া আক্তার নামে এক বাংলাদেশি প্রবাসী শিক্ষার্থী বলেন,আমেরিকার মতো একটি দেশে এমন হত্যা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। শুধু আমাদের নয়, এটা সবার মাঝে এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে। আমরা ফাহিমের এই হত্যাকাণ্ডে অত্যন্ত মর্মাহত। তিনি ফাহিম হত্যার দ্রুত বিচারসহ নিরাপদ শহরের দাবি করে বলেন, আমরা হত্যাকারীর ফাঁসি এবং বাংলাদেশি কমিউনিটিদের নিরপত্তা চাই।
লস এঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশ প্রেসক্লাব : ফাহিম হত্যার প্রতিবাদে লস এঞ্জেলেসে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। লস এঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশ প্রেসক্লাব এই মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। ১৮ জুলাই বিকেল ৫ টায় লস এঞ্জেলেস শহরের সোনার বাংলা চত্বরে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। প্রেস ক্লাব সভাপতি কাজী মশহুরুল হুদার সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লস্কর আল মামুন, লস এঞ্জেলেস মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ড্যানী তৈয়ব, ফিরোজ আলম প্রমুখ। সমাবেশে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ফাহিম হত্যার নেপথ্য মদদদাতাদের হদিস উদ্্ঘাটন এবং ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবির প্ল্যাকার্ড হাতে অংশ নেন প্রবাসীরা। এতে বক্তারা অবিলম্বে ফাহিম হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে রহস্যময় ও চাঞ্চল্যকর এ খুনের প্রকৃত কারণ উদঘাটনেরও দাবি জানান তারা।
ফাহিম সালেহর খুনির ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে বিচারের দাবি : ফাহিম সালেহর খুনির ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে বিচারের দাবি জানিয়েছে এনআরবি সাপোর্ট ইনক। সংগঠনটির পক্ষে সেক্রেটারি জেনারেল মুবাশশির করিম এক বিবৃতিতে জানান, এনআরবি সাপোর্টের পক্ষ থেকে আমরা গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি টেক এন্ট্রিপ্রেনিউয়ের বাংলাদেশ কমিউনিটির গর্ব ফাহিম সালেহর অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুতে। গত ১৫ জুলাই মঙ্গলবার ফাহিম সালেহ লোয়ার ম্যানহাটনে তার নিজ অ্যাপার্টমেন্টে এক অমানবিক মনস্টার কর্তৃক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ১৭ জুলাই নিহত ফাহিম সালেহর সাবেক কর্মচারী ডেভন হাসপিলকে খুনের আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ তাকে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার কেসে বুকিং করায় আমরা এনআরবি সাপোর্ট নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, নিউইয়র্ক পুলিশ ঘটনার নৃশংসতা বিচার করে ফাহিম সালেহর খুনির ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে বিচার করবে। মুবাশশির করিম আরো বলেছেন, নিহত ফাহিম সালেহ মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই টেক ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলাদেশ, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন তার রাইড শেয়ারিং ইনোভেশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সফল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও, নাইজেরিয়ার গোকাডা অ্যাপ ছাড়াও আরো অনেক নতুন উদ্ভাবন নিয়ে দিবানিশি ব্যস্ত থাকা সদা হাসিখুশি ফাহিম এভাবে অজানার দেশে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটি এক নক্ষত্রকে হারাল। আমরা এনআরবি সাপোর্ট নিহত ফাহিম সালেহর পরিবারের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও সমবেদনা জানাচ্ছি। ফাহিম সালেহ বাংলাদেশ কমিউনিটির জন্য এক উজ্জ্বল আলোর বাহক হিসেবে পথনির্দেশক হয়ে থাকবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, এনআরবি সাপোর্ট ইনক একটি অরাজনৈতিক অলাভজনক সংগঠন।