প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৪৩

  |  ১৫:০৮, আগস্ট ০৯, ২০২০
www.adarshabarta.com

বরেন্য সাহিত্যিক হূমায়ূন আহমদের পিতা এক সময় ছিলেন আমার নিজ থানা বিশ্বনাথের ওসি

:: মোঃ রহমত আলী ::

বরেন্য সাহিতিক্য হুমায়ুন আহমদের নিজের জীবনী ভিত্তিক একটি বইয়ের লেখা পড়ে জানতে পেরেছিলাম যে, তাঁর পিতা ফয়জুর রহমানের ছিলেন সিলেটের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আর সে সুবাদে আমার নিজ থানা সিলেটের বিশ্বনাথের ওসি হিসাবে তিনি একসময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে কারণে তাঁর প্রতি আমার একটা বাড়তি আগ্রহ পরিলক্ষিত হতে থাকে। আর তখন থেকেই আমি তার সম্পর্কে আরো বেশী জানার চেষ্টা করি। এ ব্যাপারে আমি অনেকের সাথে কথা বলেছি ও বিশ্বনাথে ছোটবেলায় হুমায়ুন আহমদ এর কোন স্মৃতি চিহ্ন বিশ্বনাথে আছে কিনা তাও অনুসন্ধান করেছি কিন্তু তা পাইনি। কারণ তাঁর পিতা বিশ্বনাথে দায়িত্ব পালন করলেও তাঁর পরিবারের সবাই সিলেট শহরে বসবাস করতেন। যেহেতু তার আগে তিনি ছিলেন সিলেট কোতোয়ালী থানায় কর্মরত ছিলেন। নগরীর মীরাবাজারের একটি বাসায় থাকতেন তারা। একচালা আধাপাকা সেই বাসাটি এখন পরিণত হয়েছে অট্টালিকায়। তবে হুমায়ুন আহমদের ব্যবহৃত পানির ইন্দিরাটি (কুয়া) এখনো আছে। নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখায় হুমায়ূন আহমদ লিখেছিলেন, সিলেট তার প্রিয় শহর। এ শহরের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। সর্বশেষ তিনি ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট গিয়ে মাজার জিয়ারত করেন। তার আগে ১৯৮০ সালে সিলেট সফরে গেলে ওই বাসা দেখে আসেন হুমায়ুন আহমদ।
সেখানে বসবাস করার কারণে ছোটবেলায় স্থানীয় কিশোরী মোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের। এই বিদ্যালয়েই প্রাথমিক শিক্ষা নেন তাঁর ছোট ভাই জাফর ইকবাল ও বোন সেপু। আর এই বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হুমায়ুনের বন্ধু হয়ে ওঠেন শংকর। শংকর গরীব হওয়ায় জীবিকার তাগিদে পত্রিকার হকারের চাকরি নেন। যখন হুমায়ুন আহমেদ হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র তখন ভুলে যাননি শৈশবের বন্ধুকে। সিলেট আসলেই দেখা করতেন শংকরের সাথে। শৈশব নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের বড় অংশই জুড়ে আছে শংকরের নাম। সেই শংকর অবশ্য এখন মারা গেছেন।
আমি এ শংকরকে চিনতাম। সে ছিল খুবই বেটে কিন্তু মাথা ছিল একটু মোটা। তাই তাকে অনেকে ‘মাথামুটা শংকর’ হিসাবে পরিচয় দিতো। সে সিলেটের বন্দর বাজার পয়েন্টে পত্রিকা বিক্রি করতো। কথাবার্তা খুবই কমই বলতো। আমি বন্দর বাজার গেলেই তার কাছ থেকে পত্রিকা কিনতাম। এই শংকরকে আমি একসময় একটি সিনেমায়ও দেখতে পাই। তখন মনে করেছিলাম যে, হয়তো তার চেহারার কারণে তাকে এ ছবিতে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তথ্য নিয়ে জানতে পারি যে, এর নেপথ্যে যিনি কাজ করেছেন, তিনি ছিলেন হুমায়ুন আহমদ। শুধু সিনেমায় নয় বিভিন্ন উপন্যাস ও নাটকেও শংকরকে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন সময়। সাথে সাথে তার ছবিও দেখতে পেয়েছি হুমায়ুন আহমদের লেখা বিভিন্ন বইতে।
জীবনে অনেক বন্ধু জুটে। কিন্তু সহপাঠিদের মত বন্ধুদের কথা অন্তত: সবারই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্মরণ থাকে। শুধু তাই নয়, যে যত বড় অবস্থাতেই পৌছান না কেন সহপাঠিদের জন্য তাদের দরজা সব সময়ই উন্মুক্ত থাকে। তাই হুমায়ুন আহমদও শংকরের বেলায় সে সুযোগ রেখেছিলেন সব সময়। তবে শংকরের বেলায় তাঁর আরও একটু বেশী আগ্রহ ছিল অন্ততঃ তার শারিরীক ঘটনের কারণে। তাকে দেখে বুঝা যেত না যে তার আসল বয়স কত।
সে যাই হোক, আমি আগেই বলেছি যে, হুমায়ূন আহমদের পিতা ছিলেন বিশ^নাথ থানার ওসি। তবে সেটা ছিল পাকিস্তান আমলে। আমাদের যারা পূর্ব পুরুষ তারা হয়তো তিনির কথা জানতেন বা তাঁকে চিনতেন। বিশ^নাথে দায়িত্ব পালনকারী ওসিদের যে তালিকা থানায় রয়েছে সে তালিকায় তাঁর নাম নেই। কারণ বর্তমান তালিকাটিতে স্বাধিনতার পরবর্তী সময় থেকে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম উল্লেখিত রয়েছে। হয়তো অন্য কোথাও তাঁর নাম রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে পাক সেনাদের হাতে নিহত হন। সে সময় তিনি ছিলেন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা।
বিশ্বনাথে দায়িত্ব পালনকারনী পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকতার সূত্র ধরে আমার পরিচয় হয়েছে। আবার যুক্তরাজ্যে থেকে দেশে গেলেও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে অনেকের সাথে। তার মধ্যে একজন ওসির কথা আমার অনেকদিন স্মরণ থাকবে। বর্তমানে অবশ্য তিনি একজন উর্ধ্বতন র‌্যাব কর্মকর্তা হিসাবে রাজধানীর পার্শবর্তী একটি জোনে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জেনেছি। তিনির নাম আবুল কালাম আজাদ। হয়তো আগামীতে তিনি আরো উর্ধ্বতন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করবেন এবং একদিন অবসর প্রাপ্ত হবেন। তারপর হয়তো কোন এক সময় বিশ^নাথ সফরে করবেন ও স্মৃতিচারণ করবেন। তবে এটা বলে রাখা ভাল যে, বর্তমানে বিশ্বনাথ থানা ভবনের সংস্কার হয়েছে ও এর প্রবেশপথ কিছুটা স্থানান্তরীত হয়েছে।

আমার সাথে তার পরিচয় ২০১২ সালের শেষ দিকে। তখন আমি আমার নিজ এলাকার স্কুলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করি। কিন্তু এগুলো সুষ্ঠভাবে কাজে না লাগানোর কারণে আমি এর প্রতিবাদ করি। কিন্তু একটি মহল এ সূত্রে অহেতুক ইস্যু তৈরি করে আমাকে নানাভাবে হয়রানী করতে থাকে। এমতাবস্থায় আমি তাঁর স্মরণাপন্ন হই। তিনি তখন প্রকৃত বিষয়টিকে অনুধাবন করতে পেরে আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি রাখেন। আর সে জন্য কতিপয় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী আমার কোন ক্ষতি করতে পারে নাই। অবশ্য উপজেলার বড় কর্তাকে তারা যে কোনভাবে ম্যানেজ করে ফেলে এবং তার পরামর্শে আমার নিজস্ব ভূমিতে নানা জটিলতা সৃস্টি করার প্রয়াস পায়।
পুলিশ বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের ধারণা যাই হউক না কেন, বর্তমানে কভিড-১৯ এর মহামারির সময় এ বাহিনী যে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তা বোধ হয় সবাই স্বীকার করবেন। করোনা আক্রান্ত রোগে থেকে শুরু করে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, খাদ্য দ্রব্য ও চিকিৎসা সেবাসহ মৃত্যুর পর দাফন করার ক্ষেত্রে যেভাবে সামনের সারিতে কাজ করে যাচ্ছেন তা এ যাবৎ কালে আর কখনো দেখা যায়নি।
দেশের অন্যান্য স্থানে যতটুকু হচ্ছে তার সাথে সিলেট অঞ্চলে এ মানবিকতামূলক কার্যক্রমের খবর হিসাবে আমি জানতে পেরেছি যে, বর্তমান এসপি ফরিদ উদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে অনেক দৃষ্ঠান্ত স্থাপন হয়েছে। যার প্রশংসায় স্থানীয় সবাই পঞ্চমুখ। আমি এটিও শুনেছি যে, বিশ^নাথ থানার বর্তমান ওসি শামীম মুসাসহ অধিকাংশ পুলিশ সদস্য এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ স্বস্ত্রীকও এ রোগের প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত হয়েছেন। যার ফলে থানার কার্যক্রম স্থানান্তরিত করতে হয়েছে।
তাই পরিশেষে এটুকুই প্রত্যাশা করবো যে, দেশের পুলিশ বাহিনী এ সব মানবিক কার্যক্রমের মধ্যমে তারা জনগণের পাশে দাঁড়াবেন ও দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করে দেশের জনগনের প্রকৃত বন্ধু হিসাবে পরিগনিত হবেন। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com