জীবনের কথা, পর্ব-৪৫
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনেক কিছু এগিয়ে গেলেও যে বিষয়টিতে সে হাওয়া লাগে না
:: মো. রহমত আলী ::
গত সপ্তাহে আমার “জীবনের কথা” কলামে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অনেক কিছু এগিয়ে বা পাল্টে যায় বলে উল্লেখ করেছিলাম। আর আজকের লেখার বিষয় যে বিষয়টিতে সে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে না সেটা নিয়ে। আর এগুলি হচ্ছে, মানুষের ও স্থানের নাম। নিজের মূল নাম নিজে রাখা যায় না। সেটা রাখেন পিতা-মাতা। তাই সেটাতে নিজের কোন ভূমিকা থাকে না। সুতরাং পিতামাতা যেভাবে রাখেন সেভাবেই চালিয়ে যেতে হয় যদিও কেউ কেউ তা পরিবর্তন করে থাকেন। কিন্তু তবুও মূল নামে অনেকেই পরিচিত হয়ে থাকেন। আর স্থানের নামও সে রকম প্রথমে যেভাবে নামটির সূত্রপাত ঘটে সেভাবেই তা পরিচিতিলাভ করে, পরে যতই তা সংশোধন বা পরিবর্তন হয় না কেন।
এই আদি নামের কারণে নেত্রকোনায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম “চোরের ভিটা” হওয়ায় বিপাকে সচেতন মহল। স্কুলটি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। স্কুলটিতে বর্তমানে ৮০ জন ছেলে ও ৯৯ মেয়ে অর্থাৎ মোট ১৭৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ১৯৯১ সনে এলাকায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন এলাকার কয়েকজন শিক্ষানুরাগী। দীর্ঘদিন পর বিদ্যালয়ের নাম নিয়ে সচেতন মহলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হলে অবশেষে প্রশাসন নাম পরিবর্তনের কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছে। আর জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নতুন নামের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আর নতুন নামটি হচ্ছে, “আলোর ভুবন”।
পুরাতন নামের ব্যাপারে স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গ্রামের নামেই সাধারণত বেশিরভাগ সরকারি স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে কারণেই হয়তো এটিও হয়ে গেছে। গ্রামের এমন নাম কেনই বা রাখা হলো এটি আসলে তাদের বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, চোরের ভিটাস্কুলের নামের এই অংশটুকু নিয়ে বিব্রত শিক্ষার্থীরা। তাই দীর্ঘদিন ধরেই নেত্রকোনার পূর্বধলার এই স্কুলের নাম পরিবর্তনের দাবি করছে তারা।
ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম নিয়েও প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। প্রায় ৫০ বছর ধরে বিকৃত এসব নাম থাকলেও ডিজিটাল যুগে পরিবর্তন চায় শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বওলা ইউনিয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ‘রামসোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’, ভাইটকান্দি ইউনিয়নে দু‘টি বিদ্যালয়ের নাম ‘মাড়া দেওরা’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ‘পশ্চিম মাড়া দেওরা’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছনধরা ইউনিয়নের বেসরকারি রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম রামসোনা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রূপসী ইউনিয়নে ‘পাগলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে রয়েছে আরো একটি বিদ্যালয়ের নাম।
জানা যায়, ১৯৭৩ সাল থেকে বিকৃত এসব নাম বিদ্যালয়ের দেওয়ালে লেখা। বিদ্যালয়ের নাম নিয়ে অনেক সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রিয় বিদ্যালয়ের নাম বলতে লজ্জা বোধ করেন। তাদের দাবি, বর্তমান ডিজিটাল যুগে নামগুলো পরিবর্তন করে শ্রুতিমধুর নাম দেওয়া অতি জরুরি। জানা যায়, স্থানীয়রাসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসব নাম পরিবর্তন করার জন্য দাবি জানালেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবনা না থাকায় যুগযুগ ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করতে হচ্ছে এমন বিকৃত নামের প্রতিষ্ঠান থেকে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, অনেক সময় বিদ্যালয়ের নাম বলতে লজ্জা হয়। মুখ ঢেকে প্রিয় প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে হয়। অনেকেই মজা করে এ নাম নিয়ে। শিক্ষাবিধ অধ্যাপক আবু তাহের জানান, বর্তমান যুগে এ ধরনের নামের জন্য শিক্ষার্থীরা মনে কষ্ট পায়। নাম পরিবর্তন করলে শিক্ষার্থিদের আত্মাবিশ্বাস আরো বাড়বে।
নীলফামারী জেলাধীন সদর উপজেলার ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ নাম পরিবর্তন করে “মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
সারা দেশে এমন কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম আছে যা শুধুতিমধুর নয় এবং ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সুশোভন নয়। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে হাস্যরসের সৃষ্টি হচ্ছে। এরূপ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শোভনীয় নাম প্রস্তাবের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর আগেও এ ধরনের কয়েকটি স্কুলের নাম পরিবর্তন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এবার এ ধরনের সব বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
তবে এ বিষয়টি আরো প্রচার-প্রচারণা ও কীভাবে তা করতে হবে সে বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ অনেক স্কুলই হয়তো আছে যেগুলিতে এ ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। কিন্ত না জানা ও সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে হয়তো তা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তকে এ বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ রইলো। সাথে সাথে যারা এ সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত অস্বস্তিতে আছেন তাদেরও এ সূযোগে এগিয়ে এসে এটা গ্রহনের সুপারিশ করছি। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com