বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নামে বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান
:: মো. রহমত আলী ::
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ১০২তম জন্মবার্ষিকী ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সে সময় তাঁর পিতা সেখানে সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনির মূল বাড়ি সিলেটের তৎকালীন বালাগঞ্জ ও বর্তমান ওসমানী নগরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অবিস্মরণীয় ভ‚মিকার কথা সবার জানা। তাই ইতিহাসে স্বনাঁক্ষরে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রতি বছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। কিন্তু সরকারীভাবে তেমন কোন কর্মসূচি পালন হতে দেখা যায়নি। তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সিলেট
‘ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সিলেট’ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দরটি দেশের উত্তর-পূর্ব কোণের বিভাগীয় শহর সিলেটে অবস্থিত। এর অবস্থান সিলেট শহর থেকে ৫ মাইল (৮ কিঃমিঃ) দূরে বড়শাল এলাকায়। যে কোন প্রকারের জানবাহনে এখানে পৌছা যায়।
এ বিমানবন্দরটি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নামানুসারে নামকরণ করার পূর্বে এটির নাম ছিল ‘সিলেট বিমানবন্দর’। তবে অনেকদিন এটাকে ‘সালিটিকর বিমানবন্দর’ হিসাবেও ডাকা হতো। বিমানবন্দরটি বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয় ও বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর জন্যও ব্যবহৃত হয়।
এ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আবুধাবি, দোহা, দুবাই, লন্ডনের হিথ্রো ও জেদ্দা থেকে সিলেটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে যদিও বর্তমানে কিছু ফ্লাই বর্তমান কভিড-১৯ এর কারণে বন্ধ রয়েছে।
এ বিমানবন্দর ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যবহার করা যাত্রীদের অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশী এবং যুক্তরাজ্য বসবাস করা সিলেট বিভাগ-এর লোকজন। বর্তমানে লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে ফ্লাইট চলাচল করলেও ফিরতী ফ্লাইট সিলেট থেকে ঢাকা হয়ে লন্ডনে গমন করছে। উভয়দিক থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার দাবি র্দীঘদিনের। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করা হয় এমনকি এ ফ্লাইট পুনরায় চালু করার জন্য রিট মামলা পর্যন্ত করা হয়। মামলার পিটিশনকারী রহমত আলী ও রিট মামলা নং-৪৯৩৮ তারিখ-১৮-০৪-২০১২।
ওসমানী নগর উপজেলা
সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে বঙ্গবীর জেনারেল মোঃ আতাউল গণি ওসমানীর নামে ‘ওসমানী নগর উপজেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস এই উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নে। এই মহান ব্যক্তির নামে তা হওয়ায় এ উপজেলা তাঁর ঐতিহ্য বহন করে। ২০১৫ সালের ১৩ জুন থেকে ওসমানী নগর উপজেলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু হয়েছে।
এর পূর্বে ১৯৯৬ সালের ১মে থেকে বালাগঞ্জ থানার অধিনে প্রথম ওসমানীনগর থানা তথ্য কেন্দ্র চালু করা হয় এবং ২০০১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ওসমানীনগর একটি সতন্ত্র থানা হিসেবে প্রতিষ্টা লাভ করে। ২০১৪ ইং এর ২জুন নিকারের সভায় ওসমানীনগর থানাকে ওসমানীনগর উপজেলায় উন্নীতকরণ করা হয়।
এ উপজেলার অধিকাংশ লোকপ্রবাসী। অধ্যুষিত ওসমানীনগনর উপজেলা কুশিয়ারা নদীর তীরে সিলেট জেলার দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত। উত্তরে সিলেট সদর উপজেলা, দক্ষিনে মৌলভীবাজার জেলা সদর, পূর্বে বালাগঞ্জ ও দক্ষিন সুরমা উপজেলা ও পশ্চিমে বিশ্বনাথ এবং জগন্নাথপুর উপজেলা অবস্থিত।
সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল বিশ্বিবিদ্যালয়
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নামে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ নামকরণ করা হয়। এটি সংক্ষেপে ‘সিওমেক’ নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে সিলেটের কাজলশাহ এলাকায় অবস্থিত। এর আগে এটি সিলেট মেডিকেল কলেজ ও মেডিক্যাল স্কুল নামে শহরের চৌহাট্টা এলাকায় ছিল। এটি সিলেটে অবস্থিত চিকিৎসা বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা দানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে যা ছিল সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী।
ওসমানী যাদুঘর
১৯৮৬ খিৃষ্টাব্দের ৪ঠা মার্চ এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ওসমানী জাদুঘরের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর জীবন সম্পর্কিত নিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ সেবায় তাঁর গৌরবময় অবদান ও স্বীকৃতি জাতির সামনে তুলে ধরতে কর্মময়, সামাজিক, রাজনৈতিক স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে ওসমানী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সিলেটের নাইওরপুল এলাকার নূর মঞ্জিলে ওসমানী জাদুঘর অবস্থিত। এটি ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এবং সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই যাদুঘরে বর্তমানে ৪৭৫টি নিদর্শন রয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবীর ওসমানীর ব্যবহৃত নানা ধরনের সাধারণ পোষাক-পরিচ্ছদ, সেনাবাহিনীর উর্দি, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, দেশী-বিদেশী জার্নাল, বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ, বেতের চেয়ার, কাঠের আলমারি, বইয়ের শোকেচ, আলনা, সামরিক ছড়া, টেলিফোন সেট, শার্ট-প্যান্ট, সুয়েটার বালিশ, তোয়ালে, পাঞ্জাবী ব্রীফকেস, জামা, জুতা, চীনা মাটির বাসন-কোসন, চামচ, ছুরি, কাঠের নৌকা, ফাক্স, টি-টেবিল ও ছাতা। সৈনিক জীবনে ওসমানীর ব্যবহৃত নানা মনোগ্রাম, পদক, ব্যাজ, শোল্ডার ব্যাজ, টুপীর ব্যাজ, বুজের ব্যাজ, বুকের ব্যাজ ভুজারী, তরবারী, পাসর্পোট, বিভিন্ন ধরনের মানপত্র, স্বাধীনতা পুরস্কার রয়েছে।
যে সমস্ত ছবি রয়েছে তার মধ্যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেবাবাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহণরত, সিলেট বিমানবন্দরে বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর বিমান থেকে অবতরণরত, সেক্টর কমান্ডার ও সহকর্মীদের সঙ্গে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে ছবি। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন যশোহরের হানাদার বাহিনী মুক্ত অঞ্চল পরিদর্শনরত, রনাঙ্গণে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও কৌশল সম্পর্কে সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশ দানরত, রনাঙ্গণে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রণাঙ্গন ও মুক্তাঞ্চাল পরিদর্শনরত, জনগনের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ জনগণের পাশে ভাষণরত ওসমানীর ছবি রয়েছে।
ওসমানী উদ্যান
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানির নামে ঢাকায় ওসমানি উদ্যান নামকরণ করা হয় এবং তারই স্মরণে উদ্যানটির পাশে ওসমানি অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হয়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উদ্যানগুলোর একটি এটি। ঢাকার গুলিস্তানে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (নগর ভবন) বিপরীত পাশে এবং সচিবালয়ের পিছনে এটি অবস্থিত। প্রাতঃভ্রমণকারীদের তথা দর্শণার্থীদের জন্য এটি খোলা থাকে প্রতিদিন। উদ্যানটিতে প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার জন্য মোট ৩টি সদর দরজা রয়েছে। মূল দরজাটি সিটি কর্পোরেশনের ঠিক বিপরিত পাশে, দ্বিতীয় দরজাটি রয়েছে গোলাপ শাহ মসজিদের পাশ ঘেষে এবং তৃতীয় দরজাটি ওসমানি অডিটোরিয়ামের পাশ ঘেষে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলার কামানটি বর্তমানে ওসমানী উদ্যানের শোভা বর্ধন করে রয়েছে। কামানটি মীর জুমলা আসাম যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন (নগর ভবন) উদ্যানটি তত্ত¡াবধানসহ যাবতীয় সংস্কার ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। উদ্যানটির ভেতরে রয়েছে গার্ড রুম। পুলিশ সদস্যরা সর্ব সময় সক্রিয় থাকেন। এছাড়া মাঝে মাঝে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কাজেই এখানে কোন ধরনের উচ্ছৃংখল বা অসামাজিক অপরাধ ঘটে না বললেই চলে।
এ উদ্যানের লেকটিতে পর্যাপ্ত পরিমান পানি প্রবাহমান থাকায় এতে ছোট বড় প্রচুর পরিমানে মাছ পাওয়া যায়। এর চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা। এখানে মহিলাগন যোগব্যায়াম সহ নানা রকমের শারিরীক কসরত করতে পারেন। শিশু এ্যারিনায় রয়েছে শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা যেমন দোলনা, ¯িø¬পার ইত্যাদি। ওসমানী উদ্যানের পূর্বদিকে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব। এটি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের পাশেই রয়েছে একটি পানির পাম্প।
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন
জেনারেল ওসমানীর নামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিশেষ করে বড় বড় সভা সমাবেশের জন্য একটি অভিজাত অডিটোরিয়ামের নাম হচ্ছে, ‘ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন’। এ মিলনায়নটি গুলিস্তানের উসমানী উদ্যানের কাছে ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (নগর ভবন) বিপরীতে এবং সচিবালয়ের পিছনে অবস্থিত। এখানে রয়েছে এ সমস্ত সভা-সমাবেশের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। সারাদিনব্যাপী ব্যবহারের জন্য এর ভাড়া প্রায় ৫০হাজার টাকা।
বঙ্গবীর ওসমানী শিশু পার্ক
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর নামে ২০০০ সালে স্থাপিত হয় বঙ্গবীর ওসমানী শিশু পার্ক। এটি সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র ধোপাদিঘির পাড়ে অবস্থিত। বঙ্গবীর ওসমানীর শেষ ইচ্ছানুযায়ি এটি স্থাপন করা হয়।
এ পার্ক তৈরীর পূর্বে সিলেট নগরীতে বিনোদনের্য উপযোগী তেমন কোন পার্ক ছিল না। দেখার মত বিনোদনকেন্দ্র এই বঙ্গবীর ওসমানী শিশুপার্ক। এখানে শিশুদের জন্য নানা ধরণের ক্রীড়া সামগ্রি ছাড়াও ঘোড়া, ট্রেন, নৌকা, চরকি রয়েছে। তারা এগুলি চড়তে পারে। সাথে সাথে দেখতে পারে বিভিন্ন ধরনের প্রানী যেমন, স্নো চিতা, বনের বানর প্রভৃতি।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com