প্রচ্ছদ

জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-৪

  |  ০৯:৪০, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

নূতন স্কুল এবং শিক্ষকদের মধ্যে সকলেই তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত তরুণ ও শিক্ষার্থী থাকাবস্তায় অবৈতনিক শিক্ষক রুপে শিক্ষাদানে ছিলেন আত্ম-নিবেদিত। সুতরাং প্রথম দিকে পরিক্ষা ও পড়ার ব্যাঘাত সৃষ্টির সমস্যা এড়াতে অনেক শিক্ষক স্বল্প মেয়াদি, কেহ দীর্ঘ মেয়াদী থাকায় সঠিক তথ্যের কিঞ্চিৎ উল্টাপাল্টা হলে পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের নিকট বিনয়াবনত চিত্তে ক্ষমা প্রার্থী। এ অনিচ্ছাকৃত ক্রুটি।জ্ঞাতসারে নয়, স্মরণের কারনে হয়তবা।অর্থ্যাৎ প্রথমার্ধে কোন কোন শিক্ষক ছিলেন এ তথ্যের বিভ্রাটের চিন্তা চেতনায় বলছি।

মার্চ মাসে প্রকাশিত ফলাফলে দৃষ্ট হয় প্রাথমিক বৃত্তি প্রাপ্তির সংবাদ।উত্তর বিশ্বনাথ স্কুল তখন মঞ্জুরী বা অনুদান প্রাপ্ত নয়।ফলে আমার/ আমাদের বৃত্তির টাকা উত্তোলনে মারাত্মক বিঘ্নতার সৃষ্টি ও সংকট। এ সুবাদে আমাকে অন্যত্র গমণ করতে হয়। কান্দি গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমি ও ঘাসি গাঁও নিবাসী আব্দুন নুর বৃত্তি দিয়েছিলাম। উভয়ই অর্জন করি সফলতা। আমাদেরকে চলে যেতে হবে অন্যত্র।আবারো চিন্তা ভাবনার বেড়াজালে আবদ্ধ। সিদ্ধান্ত হয় আমরা চলে যাব গবিন্দ গঞ্জ স্কুলে। এ সময় পরম শ্রদ্ধাভাজন প্রতিষ্ঠাতা ছাদ উদ্দিন খান, আলতাফুর রহমান ছাদ মিয়া, মরহুম উকিল আলী,মরহুম মৌলানা আব্দুল্লা, মরহুম কামাল উদ্দিন গং শিক্ষকগণ বিশেষ করে আমাকে স্কুল অনুমোদিত হবার পর ফিরে আসার আহবান জানিয়ে ( প্রসঙ্গত এলাকার তখনকার সচেতন মহল সবাই আদর করে ও ভালবাসার সম্পৃক্ততায় অপরদিকে নূতন স্কুলের ভাল রেজাল্ট প্রয়োজন হিসেবে। কিন্তু আব্দুন নুরকে এ আহবান জানানো হয়নি) হাজারী গাঁও নিবাসী প্রধান শিক্ষক মরহুম আখতারুজ্জামান কিনু মিয়া’র সঙ্গে দেন পাঠিয়ে গবিন্দগঞ্জ স্কুলে।মরহুম আখতারুজ্জামান সাহেব নিজে উপস্থিত থেকে আমার সঙ্গে ভর্তি করে দেন গবিন্দগঞ্জ এবং তিনি ঐ দিনই যোগদান করেন প্রফেসার রুপে আব্দুল হক স্মৃতি কলেজে।আব্দুল স্মৃতি কলেজের ও সবে মাত্র যাত্রা শুরু।স্কুলের পশ্চিমের ভবনের দক্ষিণাংশের দু’টি কক্ষে।আমি হয়ে গেলাম গবিন্দগঞ্জ স্কুলের ছাত্র।স্যার যাবার বেলা স্বস্নেহে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, আমি কলেজে আছি। সুবিধা-অসুবিধা হলে বল।

নূতন এলাকা, অপরিচিত পরিবেশ, সহপাঠি পরিবেষ্টিত নবজন্ম তুল্য।শতাধিক ছাত্রছাত্রী।কারো সঙ্গে সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি। ক্লাসে প্রথম দিকে প্রথম সারির বেঞ্চে স্থানই পেতাম না। আবার এক প্রকার অজানা ভয়ে নিজ থেকেই পিছনের সারিতে বসতাম। ষান্মাসিক পরিক্ষা দিলাম। অকল্পনীয় রেজাল্ট। ছাত্র শিক্ষকদের সুনজরে পড়ে গেলাম।শিক্ষকের হলাম প্রিয়, ছাত্রদের নিকট হয়ে গেলাম খ্যাতিমান। প্রথম বেঞ্চে বসার আদেশ প্রাপ্ত হলাম।পাশাপাশি অনেকের কাছে হয়ে গেলাম প্রতিদ্বন্ধি।প্রথম দিকে লজিং ছিল গবিন্দ নগর গ্রামে। পরে বুড়াইর গাঁও নিবাসী প্রয়াত শিক্ষক শফিকুল হকের বাড়িতে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সিলেট-ছাতক রেললাইনের স্কুল সংলগ্ন ব্রীজের পশ্চিম তীরের অংশটি মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এক রাত্রে বোমা মেরে উড়িয়ে দেন এবং ঐ স্থানে বিরাট একটি গর্তের সৃষ্টি হয়ে যায়। যা স্বাধীনতা অর্জনের পরক্ষণেই কাঠের মাধ্যমে পিলার তৈরী করে উপরে স্লিপার বসিয়ে রেল যোগাযোগ চালু করা হয়।কিন্তু চালু হলেও এস্থানে প্রতিবার ট্রেন যাতায়াতের সময় ধীর গতিতে যেত এবং ঐস্থানে রেল বিভাগের একজন লোক দায়িত্বরত ছিলেন।তিনি ধীর গতিতে অতিক্রম করছে ব্রীজ তা নিশ্চিত করতেন।লোকটির নাম ছিল কালা মিয়া।সবাই ডাকতেন কালা ভাই বলে।

লজিং এ বসত না মন। বাড়ির জন্য সর্বদা করতাম ছটফট ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো। সে সময় স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রবিবার। সে সুবাদে প্রতি শনিবার স্কুল ছুটির পর লজিং এ না গিয়ে সোজা বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা দিতাম। আসা হতো দু’ভাবে।হয়ত ট্রেনে, নয়তো পায়ে হেঁটে।ট্রেনে এলে নামতাম ব্রীজের নিকট। আর পায়ে হেঁটে এলে কাবিলপুর থেকে ভাটপাড়া হয়ে বাড়ি।রবিবার বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার ভোরের ট্রেনে গবিন্দগঞ্জ।স্কুল করে লজিং বাড়ি গমণ। এ ছিল তখন আমার নিয়মিত রুটিন মাফিক চলাফেরা।কখনও এর ছিল না ব্যত্যয়।

১৯৭৩ সালের জুন অথবা জুলাই মাসের মধ্য সময় এর এক বৃহস্পতিবার।যথারীতি স্কুলে আগমণ।ক্লাস শুরুর ঘন্টা পড়তেই সকল শ্রেণির ছাত্রছাত্রী বইপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।অবগত হলাম জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ কর্তৃক আহুত ধর্মঘট পালন করা। প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ও ছিল প্রচুর।এদিকে এ সময় জাসদ কর্তৃক ঘন ঘন ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদি ডাকা হত। আমার মতো সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ছিলাম অসহায়।ধর্মঘটের ফলে নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা মাথায় লাল কাপড বেঁধে মিছিল দিতেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে।সাধারণ ছাত্ররা মিছিলে অংশ না পিছু হটে চলে যেতাম বাড়ি বা লজিংএ।চালিয়ে যেতাম ঘরে বসে লেখাপড়া।কিন্তু ঐদিন লজিং এ না গিয়ে দশটার ট্রেন যোগে রওয়ানা হই বাড়ি অভিমুখে।বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি কাটিয়ে সোমবারে এসে স্কুলে ক্লাস করবো বলে মনস্থ করে আমার এ অভিযাত্রা।নিয়মমাফিক ব্রীজের নিকট এসে নেমে পড়ি।উত্তর বিশ্বনাথ স্কুল তখন শহর উল্লা সাহেবের বাংলো হতে বর্তমান স্থানে বাঁশের বেডাযুক্ত টিনের চালা তৈরী করে হয়েছে স্থানান্তরিত।স্কুলের চৌকিদার কাম পিয়ন মরহুম তাহির আলী এসে জানালেন, স্যারগণ আমাকে ডাকছেন।সে ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলাম স্কুলে।আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ তখন জানালেন স্কুল স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়েছে। আমার টাকা উত্তোলনে আর কোন বাঁধা নেই।আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি ঐদিনের মত।কিন্তু উত্তর বিশ্বনাথ স্কুল স্বীকৃতি প্রাপ্ত এবং নুতন স্থানে স্থানান্তরিত (বর্তমান স্থানে অবস্তান), লজিং ছেড়ে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করা ইত্যাদি বিষয় আমাকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। এক কথায় মস্তিষ্কে আলোড়িত হতে থাকে। যাক কয়েকদিন পর আবারো এভাবে আসি এবং স্যারদের আহবান পেয়ে মনের সাথে অনেক সাধ্যাতীত দ্বন্ধের, দ্বিধা ও সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত নেই উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলেই আমার পরবর্তী লেখাপড়া চালিয়ে যাব।কিন্তু এভাবে হুট করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলে ভবিষ্যত সমস্যার চিন্তা-চেতনা একবারও ভাবিনি। বয়সইবা কতো। তাছাড়া স্যারদের প্রতি আমার আন্তরিকতা ও দৃঢ় আস্থা নিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত, “যেমন কথা, তেমন কাজ”।অর্থ্যাৎ বাড়িতে থেকে যাই এবং উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলে ক্লাস করতে থাকি।

সপ্তম শ্রেণিতে তখন স্যারগণ ক্লাস নিতে এলে আমাকে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রেরণার নিমিত্তে বলতেন ভাল করে লেখাপড়া করো।এখানে সৃষ্টি হয়ে যায় প্রতিদ্বন্ধিতা ও প্রতিযোগিতা।আমি জানতাম, ভাবতাম শিক্ষকবৃন্দ প্রতিযোগিতামুলক হলে ভাল রেজাল্ট হবে এ ভাবনা নিয়ে উৎসাহ প্রদান।কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্ধি চলে যান শক্ত অবস্থানে।একদিন বলেই ফেলেন এবারের বার্ষিক পরিক্ষায় প্রথম হতে না পারলে তিনি স্কুল ছেড়ে চলে যাবেন। আমি নিরুত্তর ও নিরবতা পালন করি।পরিক্ষায় প্রথম স্থান হয় অর্জিত।সত্যি আমার প্রতিদ্বন্ধি অন্য স্কুলে গিয়ে আর লেখাপড়া কতটুকু হয়েছে জানিনা।(চলবে)

লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।