প্রচ্ছদ

জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-৫

  |  ১০:১০, সেপ্টেম্বর ০২, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

সত্তর দশক আমার জন্য অকল্পনীয় নির্যাতন, দুর্ভোগ, সীমাহীন যাতনা, কষ্ট, লাঞ্চনার দশক। এখানে সংক্ষেপে বলে রাখছি। শেষের দিকে বিস্তারিত বলবো।১৯৭২ সালে মহাপ্রতারণায় বঞ্চিত হলাম আমার প্রাপ্য নিজস্ব অধিকার কবরস্থান থেকে।আমার লেখাপড়া করার গৃহের অভাবে প্রতিবেশীর বিরাট গৃহ অব্যবহৃত হলেও চেয়ে পাইনি পরিক্ষার সময়টুকুর জন্য। এ আঘাত পেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনবাক্যে প্রার্থনারত। অর্ধ ঘন্টার ব্যবধানে গ্রামের একজন তিনির দু’ছেলেকে নিয়ে হাজির আমার সম্মুখে। আমি তিনির আগমণের হেতু সম্পর্কে জানার উদগ্র বাসনারত। তিনি শুরু করলেন, “ভাই আমি এসেছি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে।আমার বাড়িতে থাকবে এবং আমার এ দু’টি বাচ্চাকে পড়াবে। দিনের বেলা তোমার লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।শুনে আমি হতবাক, আশ্চর্যান্বিত।এ কেমন কথা। আমার আঘাতের কথা আমি কাউকে বলার সময় পাইনি, ঘর থেকে বের হইনি।আমি তিনবার তিনিকে না-বাচক জবাব দিয়ে যাচ্ছি।অত:পর খেয়াল এবং আমার মনে হল ধারণায় যে, হয়ত মহান আল্লাহ ফেরেশতা স্বরুপ উনিকে প্রেরণ করেছেন।তিনির এ অধম বান্দাকে সহযোগিতা করার নিমিত্তে।তাই বেরিয়ে আসে হ্যাঁ-সুচক উক্তি। সাথে সাথে তিনির সঙ্গে আগত দু’সন্তান আমার বইপত্র নিয়ে যায়”।সেখানে থেকে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হলাম।গৃহ নির্মাণ করলাম।এ বিষয়ে আরো বলার রয়েছে অনেক কিছু বলবো শেষের দিকে।ইঙ্গিতটুকু দিয়ে রাখলাম।

প্রত্যেক শিক্ষক প্রায়শ: আমাকে ক্লাসে বা ক্লাসের বাহিরে একটি কথা বলতেন।আমার মেধা দেখে, মিজান তোমার বিরাট অর্জন বা সফলতার স্বাদ রয়েছে, উপভোগ করছ। কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানি বা কষ্ট সম্পর্কে থেকে যাবে, যাচছ অপূর্ণ।দোয়া করি সফলতার জন্য নিরন্তর।কথা শুনে ভাবতাম নিরলে একাকী বসে।শিক্ষকগণ রেলের কালো ইঞ্জিনের বাহির দেখছেন, কিন্তু ইঞ্জিনের ভিতরে থাকা কয়লা জ্বলে দাউ দাউ করে যে পরিচালনার শক্তি যোগাচ্ছে, তা অন্তর চোখে দেখছেন না। আমি কখন লেখাপড়া করি তা অনুসন্ধানে ছিলেন কিছু মানুষ। কারন সবাই দেখতেন আমি সকাল সন্ধ্যা কাজকর্মে ব্যস্ত, আড্ডায় মত্ত।

ফিরে আসি সেখানে, যেখানে ছিলাম আমরা। উত্তর বিশ্বনাথে ক্লাস চলছে আমার।হঠাৎ একদিন প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান সুধালেন প্রাসঙ্গিক আলোচনায়, “তোমার ছাড়পত্র গবিন্দগঞ্জ স্কুল থেকে না আনলে বৃত্তির টাকা উত্তোলন কোন অবস্তাতেই সম্ভবপর নয় এবং ভবিষ্যতের জন্য সকল কাজে ছাড়পত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।” আমার মাথায় বজ্রাঘাত, কিংকর্তব্যবিমুঢ়।এখন কি করা। চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।ঝড়ের কবলে পড়ে দিশাহারা নাবিক।জানি না, বুঝি না, আল্লাহ ছাড়া কোন উপায় দেখি না। ডাকি তিনিকে বিনয় করে। লেখাপড়া করে কি লাভ? যদি না থাকে তার প্রমাণপত্র।এখন কি করা।মন কোন মতেই চাচ্ছিল না সেখানে যেতে অজানিত লজ্জায়।তবুও বাধ্য হয়ে পরদিনই বইপত্র ঐদিনের ক্লাস রুটিন অনুযায়ী সঙ্গে নিয়েসেখানে উপস্থিত হই।সেখানকার সবার ধারণা হয়ত বিশেষ অসুবিধায় এ ক’দিন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারিনি।দ্বিতীয় পিরিয়ড সমাপ্যে চুপি চুপি ক্লাস থেকে বের হয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে হাজির হয়ে ছাড়পত্রের কথা বলতেই প্রধান শিক্ষকের সে কি অগ্নিমুর্তি?ভয়ে আমার আর কোন কথাই বের হচ্ছিল না। ঠায় থাকি দাড়িয়ে। প্রধান শিক্ষকের কড়া নির্দেশ বেরিয়ে আসার। আমি আবার ছাড়পত্রের কথা বলি।স্যার হম্বি-তম্বি করতে থাকেন।আমি পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান, বাড়িতে থাকা শ্রেয় ইত্যাদি অসুবিধার কথা সুন্দর করে ‍উপস্থাপন করি।স্যার ধমক দিয়ে আমাকে বের করে দেন।নিরাশ হয়ে আসলেও হাল ছাড়িনি। ঐদিন সহপাঠিদের নিকট থেকে চুপিসারে বিদায় নিয়ে আসি।শুরু করলাম গবিন্দগঞ্জ এলাকায় আমার যতো আত্মীয়-স্বজন সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরি পাগল হয়ে।যার কাছে যাই। তিনি বলেন,ছাড়পত্র আজ না নিয়ে স্কুল থেকে বের হবো না।কিন্তু কার্যত: প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে সে ব্যক্তিই উল্টো আমাকে অনুরোধ করেন। সে স্কুলে থাকতে।যত প্রকার অসুবিধা দুরীকরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে সদা প্রস্তুত।আমার হিতে বিপরীত।দীর্ঘ ছ’টি মাস কি ভাবে অতিবাহিত তা বলা বাহুল্য।পাগল বেশে, আউলা কেশে, ঘুরি দেশে দেশে।নদীর একুল হারা, ওকুল ছাড়া, মধ্য নদী ঠাই।নৌকা বিহীন, বৈঠা ভিন, কেমনে কুল পাই।লোকে করে কানাকানি,ঠাট্রা বিদ্রুপের হাতছানি,তীর পায় না নৌকাখানি।পড়া গেল ভেস্তে, হাসে আস্তে আস্তে, ভাবি একান্তে।আমি আরো কয়েকবার গিয়েছি বিভিন্ন অসুবিধার কথা তুলে ধরে।প্রতিবারই বিফল। আমার মনে এক প্রকার জেদ কাজ করে, সিদ্ধান্ত নেই গবিন্দগঞ্জ যাব না এবং উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলে পক্ষ থেকেও জেদ তুল্য জবাব, “ তোমাকে যেতে দেবো না”।পাখিচিরী নিবাসী তখনকার সময়ের এক খ্যাতিমান ব্যক্তি মরহুম ছৈদ উল্লা সাহেব সিলেট শিক্ষা অফিসে ছিলেন কর্মরত।তিনির নিকট এ বিষয়ে সহায়তা ও পরামর্শ চেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবেশিত।শেষতক আসেন এগিয়ে আমার প্রাণ প্রিয় শিক্ষক আলতাফুর রহমান।সঙ্গে নিলেন নুরুল হুদা ভুঁইয়াকে। চলে গেলেন আমাকে নিয়ে গবিন্দগঞ্জ।সকাল দশটা থেকে বিরামহীন যুক্তির পর যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন আমার শিক্ষকদ্বয় আত্মীয় সেজে। অপর দিকে গবিন্দগঞ্জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক খন্ডন করেই চলেছেন।অত:পর বেলা তিন ঘটিকার সময় প্রধান শিক্ষক(গবিন্দগঞ্জ) সম্মত হলেন আমার ছাড়পত্র প্রদান করতে। চাড়পত্র হাতে নিয়ে সকল সম্মানিত শিক্ষকদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি।এদিকে লজিং বাড়ির অবস্থা সংক্ষেপে এখানে বিধৃত করছি। তাঁদের সকলের কথা ছিল যদি আমি গবিন্দগঞ্জ কলেজে যাই, তবে যেন তাঁদের বাড়িতেই যাই।আমি ওয়াদাবদ্ধ হয়েই আসতে হয়েছিল।যবনিকাপাত ঘটল একটি করুণ অধ্যায়ের।পাঠক আপনারা নিশ্চয় স্মরণ রেখেছেন এ দীর্ঘ সময় একদিকে বৃত্তির টাকা উত্তোলিত হচ্ছিল না। অন্যদিকে আমি যে সীমাহীন কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানসিক যাতনার অপরিসীম লভোগ করতে হয়েছে তা এক মাত্র আল্লাহ ও আমি ব্যতীত অপরে অনুধাবন করা অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়।কারন কবি বলেছেন,“ বুঝিবে সে কিসে……দংশেনি যারে”।সুতরাং এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি সতত এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি বিনয়াবনত চিত্তে।

আমি আসলাম উত্তর বিশ্বনাথ হাই স্কুলে।অত্র স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় তখনকার সময়ের তারুণ্যে উদীপ্ত লামাকাজী ইউনিয়নের রিলিফ চেয়ারম্যান জনাব ছাদ উদ্দিন খান মুষ্টিমেয় ক’জন সমসাময়িক তরুণের সাথে পরামর্শ করে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কথা বললেই যে হয়ে যাবে তাতো নয়। প্রতিষ্ঠায় আনুষাঙ্গিক অনেক কিছুর প্রয়োজন।এ উত্তর বিশ্বনাথ এলাকায় পূর্ব থেকেও একটি স্কুল ছিল। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় তা হয়ে যায় বিলীন।এ বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে আমার লিখিত “সিলেটের লোকাচার” গ্রন্থটিতে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস।ছাদ উদ্দিন খান পারিবারিক ভাবে তো একা নন।পরিবারে আরো রয়েছেন সদস্য।ছাদ উদ্দিন খানের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।চিত্তের সাথে বিত্তের সমন্বয়।একটি মহতী উদ্যোগ, স্থায়ী আবাসন প্রকল্প। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচেছ সম্মুখ পানে।এ প্রতিষ্ঠান থেকেই অনেকে আলোকিত হয়ে ছড়াচ্ছেন আলোর বিচ্ছুরণ। পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি সমাগত। স্কুলের ভুমিদাতা হলেন (তথ্য প্রদানে জনাব কমর উদ্দিন খান) খাজাঞ্চি গাঁও নিবাসী মরহুম (১) সামছুদ্দিন খান, (২) ছাদ উদ্দিন খান এডভোকেট(৩) বদর উদ্দিন খান, (৪) কমরুন নেছা খানম প্রমুখ।

ইতিহাস রয়েছে ১৯৭৪ সালটি বিরাট বন্যা,দূর্ভিক্ষ, দ্রব্যমুল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, চাউলের পরিবর্তে আটা,ছানা, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ভক্ষণের বৎসর।পাঠক আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি সার্বিক ভাবে এখন উম্মুক্ত তারুণ্যদীপ্ত এক মুক্ক বিহঙ্গ। না না তা মোটেই নয়। অভাগা যে দিকে তাকায় নদীর জল যায় শুকিয়ে।এ সময়ই সংগঠিত হয় বড বেদনা বিদুর করুণ আরেকটি ঘটনা আমার জীবনে।“জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ, মোর যে বার মাস-ই মাঘ” আমার অযথা কি এ সৃষ্ট বাক্যটি।কষ্ট আমায় ঘিরে রাখে গাছের সহিত লতার প্রেমে, কষ্ট ভালবাসে মোরে তারে ভুলি কোন অসমে।অঢেল সম্পদ বাবা হারালেন স্বল্প দিনে।গান গাইলেন , মন যোগালেন জনতার, দালাল করল সর্বহারা কেড়ে সম্পদ আমার। কিন্তু বাবা সর্বদা থাকতেন উৎফুল্ল।তিনির একটি আপ্ত বাক্য ছিল “No চিন্তা , Do ফুর্তি” আনন্দের আতিশয্যে।পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমিও সর্বদা কষ্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দৃঢ় সংকল্প ও আস্থায় চলেছি সফলতার লক্ষ্যে মহান রবের আশ্বাসে।শুরু করি কাহিনীটি- (চলবে)

লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।