জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-১০
:: মিজানুর রহমান মিজান ::
এদিকে ১৯৭৯ সালে আমি এইচ.এস.সি পাশ করে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ডিগ্রিতে ভর্তি হবার। ভর্তি হতে সক্ষম হলাম। মাত্র এক মাস নিয়মিত হতে পেরেছিলাম ডিগ্রি ক্লাসে। কিন্তু একটি বইও আমি ক্রয় করতে পারিনি বা ক্রয় করিনি। কারন এক মাস পরই আমি সিদ্ধান্ত নেই লেখাপড়া ছেড়ে দেবার। এমন কি ছেড়ে ও দেই। বি.কম ক্লাসের কোন বই বা কলেজে এক মাস ব্যতীত কোন হাজিরাও নেই আমার। একদিন কি কাজে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করার প্রয়োজন হলে আমাকে মদন মোহন কলেজে যেতে হয়। কলেজে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দেখে, কলেজের পরিবেশ দেখে আমার মন হয়ে উটে উথলা। কেন যেন মনে হতে লাগলো লেখাপড়ার কথা। মন কেন জানি বার বার বলছিল, আমি পরিক্ষা দেব, পরিক্ষা দিতে চাই।চলে আসলাম বন্ধুকে দেখে।কিন্তু ভাল লাগছিলো না কোন কিছু। মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল বার বার অনির্বার।আবার চিন্তা আসতে লাগলো আমি তো প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হবার পরিক্ষা ও দেই নাই।কোন বেতন পরিশোধও করিনি। সর্বোপরি একদিন হাতে নিয়ে বই দেখিনি, এমন কি কোন বই কিনিনি।অনেক ভেবে চিন্তে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাই পরিক্ষা নামক শব্দটিকে।তারপর ও বার বার আসে ভাবনা, চিন্তা পরিক্ষা দেবার। এমতাবস্তায় একদিন আশ্রয় নিলাম বাবু স্বপন কুমার দাসের সাথে। বললাম আমার মনের কথা, চিন্তা, ভাবনার কথা।তিনি হলেন হতবাক। এ কি কথা মিজান। কারন তিনি জানেন আমার কথা।লেখাপড়া ইতি দিয়ে চাকুরী নিয়ে ব্যস্ততার কথা। আসছি সে প্রসঙ্গে একটু পরেই।স্বপন বাবুকে অনুরোধ জানালাম, “ একদিন তিনি আমাকে সময় দিতে এবং প্রিন্সিপাল কে.কে. পালের বাসায় যেতে সন্ধ্যার পর পরই। ”তিনি রাজি হচ্ছিলেন না প্রথমে।আমিও নাছোড় বান্দার মত তিনিকে ছেড়ে কোন কথা শুনছিলাম না, মানতে পারছিলাম না। আমার একই কথা আমি পরিক্ষা দিতে চাই, সুযোগ নিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।তিনি সম্মত হলেন। নিয়ে গেলাম প্রিন্সিপালের বাসায়। সেখানে উপস্থিত হয়ে আমার আবেগ, আমার ইচ্ছা, আমার আকুতির কথা যথা সাধ্য উপস্থাপন করলাম স্যারের নিকট। স্যার আমার উপস্থাপনা শুনলেন মনোযোগ সহকারে। বললেন মিজান তুমি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত পরিক্ষা দাওনি, বই নেই বলছ, বেতন পরিশোধ করনি, লেখাপড়া করনি, টেষ্ট পরিক্ষা দিবে আর বাকি মাত্র এক মাস । এসেছ ডিগ্রি পরিক্ষা দিতে। নৌকাবিহীন, বৈঠা বিহীন সমুদ্র পাড়ি দেবার কথা ভাবছ কেমন করে? আমি স্যারের প্রশ্নের উত্তরে শুধু জানাই স্যার আমি পরিক্ষা দিতে চাই। যদি আপনি আমাকে সুযোগ দেন।আমি আপনার আশির্বাদ ও মহান আল্লাহর ভরসায়, দয়ায় পরিক্ষা দিতে ইচছুক।
অনেকক্ষণ স্যার ভাবনা চিন্তা করে বললেন, তুমি কাল কলেজের সমুহ পাওনা পরিশোধ করে টেষ্টের প্রস্তুতি নাও। আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে শুধালেন, পড়বে তো বাকি ক’টা দিন, আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন অত্যন্ত স্বস্নেহে আদর মাখা বিচলিত কণ্ঠে।
এ আশ্বাস পেয়ে কি পরিমাণ যে আনন্দিত হয়েছিলাম আমার মতো নগণ্যে তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।শুধু অনুভুতিই জন্মে। এ অনুভুতির রঙ রুপ, আকৃতি বিহীন। মনোযোগ দিলাম লেখাপড়ার প্রতি অত্যন্ত যত্ন সহকারে। পাঠক খেয়াল রাখবেন এক্ষণে আমি কিন্তু উত্তর বিশ্বনাথে চাকুরীরত।
এখন আবার আমাকে একটু পিছন ফিরে যেতে হবে।মাদ্রাসায় চাকুরী করে চলছে আমার জীবন নৌকা অপারের আশায়। জোহরের নামাজ আদায় করতাম মাদ্রাসা সংলগ্ন তেলিকুনা জামে মসজিদে।অতি সন্নিকটেই তেলিকুনা প্রাথমিক বিদ্যালয়। নামাজে আসতেন নিয়মিত প্রধান শিক্ষক জনাব নছির উদ্দিন খান সাহেবও। কয়েকমাস পর একদিন নছির উদ্দিন খান আমায় ডাকলেন, নিয়ে গেলেন সংলগ্ন মাকুন্দা নদীর তীরে। প্রাসঙ্গিক কোশলাদিসহ অনেক কথা বার্তার পর শুধালেন উত্তর বিশ্বনাথের কথা। চাকুরীর কথা।প্রসঙ্গটি উত্থাপন হতেই আমি না-সুচক জবাব দিয়েই কেটে পড়ি।ভিতরে কিন্তু জ্বলছে তুষের অনল।কারন এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম পূর্বেকার ঘটনাবলী। তিনির কথায় মনে জেগে উঠে সেই কথা।তারপরও তিনিকে বলতে নারাজ।পূর্বের কোন কথা বলতে নারাজ। এমন কি এ বিষয়ে কারো সাথে কোন দিন কোন কথা বলিনি আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয় সংক্রান্ত।দিন যায়, মাস যায়। ঘুরে আসে বৎসর। প্রায় সময় নছির উদ্দিন খান সাহেব আমাকে অনুরোধ করতে থাকেন। আর আমি বার বার তা এডিয়ে যাই, না-সুচক জবাবের মাধ্যমে। একদিন অতিষ্ট হয়ে আমি তিনিকে পূর্বের কথা বলি সম্পূর্ণ খুলে। তিনি হয়ে যান হতবাক। এ হতবাক হওয়া আমাকে লোক দেখানো না সত্যি আন্তরিকতায়, তা নিয়ে ভাবিনি কখনও। আমার বেদনাটুকু আমার হৃদয় রাজ্যেই রাখতে চাই। চাইনি অন্যকে এ বিষয়ে অবহিত করে বিষিয়ে তুলতে। অথবা ঝামেলা বাড়াতে।এরপর থেকে শুরু হল নছির উদ্দিন খান সাহেবের অনুরোধ সর্ব বিষয় জ্ঞাতসারে। বরাবরই আমার না-সুচক জবাব। অত:পর একদিন মাওলানা অলিউর রহমান সাহেব আমাকে এ বিষয়ে বলেন। আমি না-বাচক জবাব দিয়ে চলে আসি।পরদিন আবারো মাওলানা সাহেব বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় আসেন। আমি অনেকবার না বলতেই থাকি।কারন একদিকে আমার ব্যথা, বেদনা বিদুরতা, অন্য দিকে মাওলানা সাহেব আমাকে পরিক্ষা করছেন কি না তা শেষ অবধি বুঝতে। তিনি হয়তো ভাববেন দু:সময়ে আমি মিজানকে আশ্রয় দিলাম। কিন্তু অধিক বেতন প্রাপ্তিতে বা আশায় আমার মাদ্রাসা থেকে চলে গেল।শেষ পর্যন্ত তিনি শুধালেন মিজান উত্তর বিশ্বনাথের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন।উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অত্র এলাকার। তাই তুমি সেখানে গেলে বেশ ভাল হয় এবং এলাকা তোমাকে চায়, প্রতিষ্ঠান তোমাকে ডাকছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়তো ভাবছ আমি কোন কিছু বলবো কি না? আমি অত্যন্ত খুশি মনে তোমাকে সেখানে পাঠাচিছ। তিনির এ কথা শ্রবণ করে আমি পেছনের কথা তিনিকে স্মরণ করে দিলে তিনি অভয় প্রদান করেন এবং আমার সাথে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো থাকবেন আশ্বস্থ করায় সম্মত হই। তারপর ও আমার শর্ত ছিল তিনির প্রতি, তিনি নিজে নিয়ে গেলে আমি যাব, অন্যথায় আমার যাওয়া হবে না।সাব্যস্ত হয় ম্যানেজিং কমিটির মিটিং এ তিনি উপস্থিত থেকে কথাবার্তা বলে কাজ সমাধা করা হবে।অত:পর ২৪/৫/৮১ খ্রিষ্টাব্দে ম্যানেজিং কমিটির মিটিং এ উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় স্পষ্টত সহ.শিক্ষক হিসাবে ৩/৬/৮১ খ্রিষ্টাব্দে আমার যোগদান নিশ্চিত করা হয়। আমি মাদ্রাসার সমুহ দায়িত্ব ২/৩/৮১ খ্রিষ্টাব্দে বুঝিয়ে ৩/৬/৮১ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলে যোগদান করি। ঐদিন থেকে ক্লাস নিতে থাকি।প্রধান শিক্ষক বললেন নিয়োগ লেটার দিচ্ছি সাময়িক অসুবিধা দেখিয়ে। ৮/১০ দিন অতিক্রান্তে আমি নিয়োগ লেটার চাইলে তিনি পর দিন নিয়োগ লেটার আমাকে প্রদান করেন করণিক বনাম সহ. শিক্ষক হিসাবে।
নিয়োগ লেটার দেখে আমি হয়ে যাই বিস্মিত।স্মরণ হয়ে যায় পূর্বের কাহিনী। প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞাসিলে উত্তর দেন এ মুহুর্তে পদ খালি না থাকায় দিয়েছি। ৫/৬ মাস পর দিয়ে দেব। মিটিং এ সিদ্ধান্ত যখন হয়, তখন কেন তিনি তা আড়াল করেন এর সঠিক জবাব দিতে ইত:স্তত করলে আমি নিরবে স্কুল পরিত্যাগ করে চলে আসি। অবহিত করি মাওলানা সাহেব, কমিটির সদস্য মরহুম সাজিদ আলী পাখিচিরী ও সোনাহর আলী পালেরচক নিবাসীকে। দিন বিশ/পচিশেক অনুপস্থিত থাকি নিয়োগ লেটার না প্রাপ্তি পর্যন্ত।অত:পর স্কুলে সৃষ্টি হয় গোলযোগ অন্যান্য কিছু বিষয়াদি নিয়ে। আমাকে তখন পত্র লেখেন।
কমর উদ্দিন খান (ফটিক)স্যার ও আব্দুল ওয়াহিদ।পর পর দু’টি চিঠি। তা এখানে উপস্থাপন করতে চাই পাঠকের সুবিধার্থে।এর পূর্বে কিন্তু কোন সহযোগিতার আভাষ আমি পাইনি নিশ্চয়তার সহিত।তাঁদের থেকে আশ্বস্থ ও কমিটির পূর্বোল্লিখিত সদস্যদের আশ্বস্থতায় আবার ফিরে যাই স্কুলে। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ লেটার প্রদানের জোরালো নিশ্চয়তা প্রদান করেন ২/১ দিনের মধ্যে দেবার।একে একে দিন যায়। এমতাবস্তায় পরিক্ষাকে উপলক্ষ করে অতিবাহিত হয়ে যায় দিনেক পনের। আমার রাগ চরমে পৌছে।একদিন দৃঢ়তার সহিত আলাপ জুড়ে প্রধান শিক্ষকের সহিত উদ্ধার করি নিয়োগ লেটার দ্বিতীয়টি।
ক’দিন পর প্রধান শিক্ষক আমার অজান্তে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে সর্বত্র। ডাকযোগে আমার কপি পৌছে ৫দিন পর।নোটিশ প্রাপ্তির
পরবর্তী দিন স্কুলে হাজির হয়ে প্রধান শিক্ষকের নিকট তার কারণ জিজ্ঞাসিলে বলা হয় এক মাস অনুপস্থিতির কথা। আমি মৃদু হেসে জবাব প্রদান করি-বাহ প্রধান শিক্ষক চমৎকার আপনার বিদ্যার বহর। আমিও দেখে নেব একই প্রতিষ্ঠানে, একই তারিখে, একই ব্যক্তি, দু’টি পদে কেমন করে দু’টি নিয়োগ লেটার প্রাপ্তি ঘটে তার পরিসমাপ্তি।শুরু হয় প্রধান শিক্ষকের দৌড়ঝাঁপ আপোষে আমার সহিত সমাধানের নিমিত্তে। শুধু মাত্র আমার স্কুল, আমার এলাকার প্রতিষ্ঠানের সমুহ ক্ষতির সম্ভাবনার দিক বিবেচনায় একটু পিছিয়ে পড়ি।তবে আমার কথা থাকে আপনি কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেছেন, তা আপনাকে সমাধান করতেই হবে। অন্যথায় আমিও প্রস্তুত পরবর্তী নোটিশের অপেক্ষায় থাকবো।আর নোটিশ আসেনি আমিও অগ্রসর হইনি স্কুলের পানে চেয়ে।চলে আমার কর্মজীবন নিয়মিত পাঠদানের মাধ্যমে। (চলবে)
লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।