বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মানস ও বাংলাদেশের ভিত্তি
:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::
বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, শেষ পর্যন্ত জাতির জনকে পরিণত হওয়া, পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড এগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক প্রবন্ধ, বই লেখা হয়েছে। এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল ফিলোসফি বা রাজনৈতিক দর্শন এবং সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা। সৃষ্টিকর্তা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র, মানুষ দুনিয়াতে যা কিছু সৃষ্টি করেছে সবচেয়ে বড় সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি না থাকত আমাদের যা কিছু অর্জন বিজ্ঞান, সমাজ, ধর্ম, উদ্ভাবন, সবই ভূলুণ্ঠিত হতো। রাষ্ট্র কাঠামো আছে বলেই সব রক্ষিত হচ্ছে। যেটা আজকের বাংলাদেশ, এই ভূখন্ডে বিভিন্ন রকমের রাজা ছিল, সামন্তবাদী জমিদার ছিল, ভূইয়ারা ছিল, এমন বহু কিছু ছিল, কিন্তু এই অঞ্চল কখনও একটা আধুনিক রাষ্ট্র হবে সেটা কখনও কেউ চিন্তা করেনি (Khan, 1996; Ahmed,1975)| ।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তিনি কিভাবে করলেন সেটা শুধু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যায়। ইবনে খালদুন, হিস্টোরিগ্রাফির জনক ১৩৭৭ সালে তার বিখ্যাত বই মোকাদ্দিমায় লিখে গেছেন, যে প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে এই প্রেক্ষাপট কেউ বিস্তারিত না জেনে কোন কিছু উপস্থাপন করলে, ঐ আলোচনাটা পূর্ণাঙ্গ হয় না (Khaldun, 1962)। বাংলাদেশ নামক এই যে রাষ্ট্রের আমরা মালিক সেটা কিভাবে আমরা পেলাম, কি অবস্থায় এটা তৈরি হলো-এর প্রেক্ষাপটটা একটু বলি। প্রথমে আমি অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। কারণ অবিশ্বাস হচ্ছে কোন কিছু শুরু করার জন্য ভাল কাজ। এটা আমি বলছি না, রেনে দেকার্তে, ফরাসী দার্শনিক ১৬৩৭ সালে ‘Discourse on Method’ বইয়ে বলে গেছেন। কোনকিছু শুরু করার সময় অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে আমি একটা অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। আসলে ‘আমরা কখনই অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না’। আমাদের সমাজে বহু আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকতা ছিল। আমি একটি উদাহরণ দেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘আমার এক বন্ধু ননীকুমার দাস, একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকা’র বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে (রহমান, ২০১২: পৃ. ২৩)।’ ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের কথা আমরা জানি। আজকে আমাদের ইসলামী জাগরণের কবি, যিনি অনেক ইসলামী গজল লিখেছেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আবার অনেক শ্যামা সঙ্গীত, ভজনও লিখেছেন। তিনি ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচনের ক্যাম্পেইন করার জন্য ফরিদপুর পর্যন্ত এসেছিলেন। ফরিদপুরের লোকজন ইসলামী জাগরণের কবিকে একদিন এক রাত পানিও খেতে দেননি। বলেছিল ‘এটা’ হিন্দু হয়ে গেছে। যেহেতু শ্যামা সঙ্গীত লিখেছে, ভজন লিখেছে, অতএব সে আর মুসলমান নেই। আমি প্রেক্ষাপটটা বুঝার জন্য একথা বলছি। ব্রিটিশরা যখন ঔপনিবেশিক শাসন ছেড়ে চলে যাবে বা যেতে বাধ্য হচ্ছে তখনই আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই ভূখন্ডে বসবাসকারীদের একেবারে দুটো জাতিতে বিভক্ত করে। একটা হিন্দু, আরেকটা মুসলমান। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা তাদের চক্রান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান এবং ভারত দুটো রাষ্ট্র তৈরি করে (Jalal, 1985; Rashid, 2012)। আমাদের এলাকার অর্থাৎ এই পূর্ব-বাংলার লোকেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য ভোট দিয়েছিল। হিন্দুদের একটা রাষ্ট্র। মুসলমানদের আরেকটা রাষ্ট্র। যদিও এর মধ্যে কারসাজি ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে কখনই এরকম একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভাবনা স্থান পায়নি, এটা তার মাথায় ছিল না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঙালী জাতীয় চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশই তাঁর কল্পনার রাষ্ট্র ছিল। তবে সে সময়ের বাস্তবতায় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে হঠাৎ করে একটা রেডিক্যাল কিছু করা বাস্তব সম্মত নয় বলেও মনে করতেন। যার কারণে আজকের যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল, সেটা কিন্তু প্রথমে আওয়ামী লীগ ছিল না। আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল। ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু অনেকটা একক কর্তৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন (ঘোষ, ২০০৯; খান, ২০১৪)। শুরুতেই যদি এই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম বাদ দেয়া হতো তাহলে দলটি এভাবে এ পর্যায়ে আসতেই পারত না। কারণ মানুষের মন মানসিকতা তখনও ঐভাবে তৈরি হয়নি। একটা সাম্প্রদায়িক ভাব মানুষের মনে যে কোন কারণেই হোক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষের দিকে এসে জোরালো হয় (Ahmed, 1975)। তারপরেও পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান তৈরি হলো। প্রথম আঘাতটাই আসে আমাদের ভাষার উপরে। আমাদের ভাষা সম্পর্কে যখন আলোচনা হয় তখন ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারির কথাই বলি, যার ফলে পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্র ভাষা স্বীকৃতি পেল বাংলা।
আরেকটা প্রচলিত বিশ্বাস, আমরা প্রায়ই বলি স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতি ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। এটাও আমি বিশ্বাস করি না। আসলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হইনি। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে মিটিংয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল- এই যে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্র হলো, এর রাষ্ট্রভাষা কী হবে? সেখানে যত বাংলা ভাষাভাষী এমসিএ ছিল, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া সবাই বলেছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। পাকিস্তান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, এদেশে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া যাবে না। মাত্র ১০ জন বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিল, এটা বড় অন্যায়। পরদিন পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১১০ জন বুদ্ধিজীবী। আমরা যে বলি সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে, এটা সঠিক বলি না। পরবর্তী পর্যায়ে ছয়দফা আন্দোলনের প্রথম দফাটি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র করা হবে (Rashid, 2012)। আর একে কেটে একটা রাষ্ট্র করা হলো। প্রত্যেকটা স্টেটকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সেটা ছিল ৬ দফা। ভারত ৬ দফা প্রণয়ন করে দিয়েছে এটা বলার বহু লোক এদেশে ছিল (খান, ২০১৮: ১৬৮-৬৯)। আর এ কারণে খোদ বাঙালীর জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৬৬) ছয় দফার পক্ষে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ পুস্তিকায় জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখন উঠিয়াছে তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈচৈ করিয়া উঠিয়াছে। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুক্তির সনদ একুশ দফা দাবি, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষালাভের মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। আমার প্রস্তাবিত ছয়দফা দাবিকেও তেমনিভাবে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করবার দুরভিসন্ধী আরোপ করতেছেন।’
জামায়াত ইসলামী শেখ মুজিবকে ভারতের ‘এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে ছয় দফা ভারতের প্রণীত বলে দাবি করে। বামপন্থী বিভিন্ন দল এমনকি ন্যাপ (ভাসানী) ছয় দফার সমালোচনা করেছে। ছয় দফার বিরুদ্ধে ন্যাপ-ভাসানী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল। বাঙালীকে হতবাক করে দিয়ে মাওলানা ভাসানীও ছয় দফাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন (খান, ২০১৮ : ১৬৯)। বস্তুত ৬ দফার মধ্যে সরাসরি স্বাধীনতার কোন কথাও ছিল না। স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন আওয়ামী লীগ পেয়ে যায়। তবে ভোটের হিসাবটা ভিন্ন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৭২. ৫৭ শতাংশ (Maniruzzaman, 2009: 69)। নির্বাচনী এই ফলাফলের আরেক অর্থ হলো- ৬ দফার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ২৭.৪৩% বাঙালী। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই দেশের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি লোক স্বাধীনতা তো দূরের কথা, ৬ দফারও বিরুদ্ধে ছিল। অতএব আমরা সমগ্র জাতি মিলে যুদ্ধ করেছি এটা সঠিক বলি না। এই ২৭.৪৩% শতাংশ লোক মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদেরকে আমরা বলি আলবদর, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং হত্যা, রাহাজানি, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এ সমস্ত কাজে তারা অংশগ্রহণ করে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে। এ কথাগুলো বলছি এ জন্য, শত্রু চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এরা ছিল আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রু। আন্তর্জাতিকভাবে গুটিকয়েক দেশ ছাড়া সারা পৃথিবী আমাদের বিপক্ষে ছিল (Sisson and Rose, 1990)। আমাদের আজকের বন্ধু চীন, আমাদের যত লোক নিহত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, এর অধিকাংশ লোককে চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। কারণ চীন ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমেরিকারও একই অবস্থা। সৌদি আরবের বাদশাসহ সবাই এদেশে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকে সমর্থন করেছিল (Shelly, 2007)। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দেশ বিজয় লাভ করার মাত্র ৯ দিন আগের ঘটনা, ৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে বিপক্ষে ভোটাভুটিতে ১১০ দেশ আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল (হাসান, ২০০৯)। আমি শত্রু চিহ্নিত করছি শুধু দেশের স্বার্থে। সৌদি আরব আমাদের স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায়। প্রথমে নিশ্চিত হয় যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দাফন কাফন সম্পন্ন হয়েছে, এর পরেই আমাদের স্বীকৃতি দেয়। বিদেশী শত্রু যারা ছিল তাদের আবার শাখা প্রশাখা ছিল দেশের ভিতরে। যাদেরকে আমরা বলি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী। ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে যাদের সারা পৃথিবীব্যাপী প্রভাব ছিল। এদের বিভিন্ন সংঘবদ্ধ দল যেমন, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি। প্রত্যেকটা দল অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল এবং কোথাও কোথাও তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য এই সংঘবদ্ধ দলগুলো সক্রিয় ছিল। এই যে ত্রিপক্ষীয় শক্তি, দেশের অভ্যন্তরীণ দালাল, বিদেশী শক্তি এবং তাদের দালালরা সবাই আমাদের অগ্রসর চিন্তার বিপক্ষে ছিল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ একদিকে সেনাবাহিনীর একটা দল চলে গেল শেখ মনির বাড়িতে, এক গ্রুপ চলে গেল আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে, অন্যদল চলে গেল ৩২ নম্বরে, একটা দল চলে এলো রেডিওতে (জামিল, ১৯৯৮)। রেডিওতে যারা এলো তারা এসেই স্বাধীনতার স্লোগান ‘জয় বাংলা’-কে নির্বাসিত করে পাকিস্তানী কায়দায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ঘোষণা করে, বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেবলমাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা বদল করার একটা অভ্যুত্থান ছিল না। তখন বিভিন্ন দেশে প্রায়ই অভ্যুত্থান হতো, এই অভ্যুত্থ্যানের কারণ ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা বদল করা। সকালে একজন, বিকেল বেলা আরেকজন। তখন কমন একটা ব্যাপার ছিল ক্ষমতা দখল। পুরা বিশ্ব কোল্ড ওয়ারের আওতায় ছিল। রাশিয়ান বলয়, আমেরিকান বলয়। পাল্টাপাল্টি এগুলো ছিল। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান, এটা এরকম ক্ষমতা দখল করার একটা অভ্যুত্থান ছিল না। একদল সেনাবাহিনীর থেকে আরেক দল সেনাবাহিনীর জেনারেল ক্ষমতা নেয়ার অভ্যুত্থান নয়। পুরো রাষ্ট্রটাকে বদল করার অভ্যুত্থান ছিল সেটা।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন সব কিছুকে নিয়ে ’৭১ এ যখন মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করলাম, একে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের যত অনুষঙ্গ ছিল, সব ফিরে এলো। একজনের পর একজন জেনারেল আসলো, আমাদের পুরো গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দী করা হলো। আমরা ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ ছিলাম ২০-২২ বছর। আমাদের প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে ছিল, তথাকথিত হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমেই বৈধতা কেড়েছিল। তথাকথিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে থেকেই নির্বাচিত হতো। এরপরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ক্যান্টনমেন্টে থাকত। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী ক্যান্টনমেন্টে থাকত। প্রেসিডেন্ট বদল হলো, ‘শর্ষিনা-সানগ্লাস-সাফারি’ থেকে ‘আটরশি-হেলিকপ্টার-মেরীর’ দিকে চলে গেল। জেনারেল শুধু বদল হলো। একই বলয়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সার্বভৌমত্ব আটকা পড়ল। আমাদের যা কিছু আছে অর্থাৎ বাঙালীর যা কিছু ছিল সবটাই ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হলো। আমি তো মনে করি বঙ্গবন্ধু আমাদের যে দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, ১৯৭৫’র পর সে রাষ্ট্রটি ছিল না। এটা কেবল পুনরুদ্ধার করা হয় ১৯৯৬ সালে, পাকিস্তান থেকে আবার বাংলাদেশ। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেটার পুনঃজন্ম হয়। আমরা এখন একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে যেরকম ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হয় তা হলো সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটা বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের কথা। গণতন্ত্রের একটা সংজ্ঞা আছে যেটা আব্রাহাম লিংকন দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যদি নেন তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রের ভিতরে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা যাবে। গণতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা এটা বলা যাবে না। এরচেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর নেই বলে আমরা বলি এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা। গণতন্ত্র বলতে বুঝানো হয় সবাই যেটা বলবে অথবা মেজোরিটি লোক যেটা বলবে এটাই মেনে নেয়া। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, একজনও যদি ন্যায্য কথা বলেন সেটা মেনে নেয়াই হচ্ছে গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘…যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা কি হওয়া উচিত? গণতন্ত্র বলতে বঙ্গবন্ধু কি বুঝালেন? আমরা সনাতনভাবে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝি, সবাই মিলে বা বেশিরভাগ লোকে যা ভাল বুঝি, সেটাই গণতন্ত্র। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে সবাই মিলে ভুল করছে। অধিকাংশ লোক বা সব লোক যা বলছে তাই সত্য? মানুষের মধ্যে সবাই মিলে যা বলে তাই সত্য হিসেবে ধরে নেয়ার একটা প্রবণতা আদিকাল থেকে ছিল। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এটি তো কিতাবেও লেখা ছিল। সবাই যেহেতু এটা বলছে আর সবাই যেহেতু এটা লিখছে আর কিতাবে যেহেতু আছে সেটাই সবাই বিশ্বাস করছে। আসল সত্যটা হচ্ছে, সূর্য স্থির আছে। পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এটা বলতে গিয়ে অনেকের জীবন চলে গেছে। অতএব গণতন্ত্র বলতে সবাই যা বুঝে- তা গণতন্ত্র না। অথবা বেশির ভাগ মানুষ যা বোঝে তা গণতন্ত্র না, যা ন্যায্য কথা, যা সত্য কথা-তাই গণতন্ত্র। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল গৃহীত হওয়ার পরদিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন:
‘আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের নয়। এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। যে মানুষের কাপড় নেই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বুকের হাড্ডি পর্যন্ত দেখা যায়, আমি জীবনভর এদের সঙ্গে থেকে সংগ্রাম করেছি। এদের পাশাপাশি রয়েছি। কারা নির্যাতন ভোগ করেছি। আমার সহকর্মীরা জীবন দিয়েছে। তাদের দুঃখ দূর করার জন্য আমি একদিন এই হাউজে বলেছি, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই [ … ] যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের।’
আমাদের জাতীয় পরিচয়টা কি হবে, আমরা এটা নিয়েও অনেক সময় বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমরা বাঙালী ছিলাম তারপরেও তো আমাদেরকে বাংলাদেশী করে দেয়া হলো। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমাদের যে সংবিধান, জাতির জনক ১৯৭২ সালে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, সে সংবিধানের একটা স্তম্ভ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে যে ভাষণ দিয়েছিলেন ‘আমি বাঙালী, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’ এই তিনটি পরিচয় অর্থাৎ বাঙালী, মুসলমান, মানুষ- এর সংমিশ্রণটা আমরা পেয়েছি। একটা কথা বলতে চাই, আমরা যে মুসলমান এটার সঙ্গে মরুভূমির মুসলমানের পার্থক্য আছে। মুসলমান হয়েছি আমরা বেশিদিন হয়নি। ১২০৫ সালে এই এলাকায় উল্লেখ করার মতো মুসলমান ছিল না (Khan, 1996)। আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অল্পকিছু মুসলমান ছিল। মূল বাংলাদেশে কোন মুসলমান ছিল না।
তার আগেও তো আমরা মানুষ ছিলাম, ১২০৫ সালের আগে আমরা বাঙালী ছিলাম। যে সকল কারণে আমরা ফরাসী না, জার্মান না, চাইনিজ না, এজন্য আমরা বাঙালী। আমরা যেভাবে আছি, যেভাবে খাই, যেভাবে চলাফেরা করি, আমাদের পোশাক-আশাক যা দিয়ে বুঝা যায় আমি একজন চাইনিজ না, আমি একজন ফরাসী না, আমি ইংরেজ না, এজন্য আমি বাঙালী। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সামাজিকতা, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের গান, আমাদের নাটক, নৃত্য, সাহিত্য, উৎসব এই সবকিছু মিলেই আমরা অন্যদের থেকে একটু আলাদা (মুরশিদ, ২০১২)। আমাদের দেশে যখন ইসলাম আসে, বড় বড় ওলামা সাহেবরা এখন যেভাবে ইসলাম নিয়ে কথা বলেন তাদের মত ওলামারা তখন আসেননি। যারা ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন সুফি, সাধক- শাহজালাল, বায়েজিদ বোস্তামি, খান জাহান আলী প্রমুখ (Ahmed, 1981)। আমরা যাদেরকে অলি বলি এই টাইপের লোকজন ছিলেন। তাঁরা আমাদের বলেছিলেন আল্লাহ্্ এক, নামাজ পড়, চুরি করো না, মিথ্যা বলোনা- এর চেয়ে বেশি কথা বলেননি। বলেছেন, তোমরা যেভাবে আছ সেভাবে থাক। বাঙালীর মধ্যে যা আছে তা নিয়েই থাক। ইসলাম এত দ্রুত একসেপটেড হলো কিভাবে? মাঝখানে ১০০০-১৫০০ মাইল দূরত্বে কেন এরকম হলো? এই এলাকার লোকজনদের ধর্ম প্রচারকরা বাঙালী সংস্কৃতি যেটা ছিল এর সঙ্গে মিশ্রণ করার জন্য ইসলামের কতগুলো আদি ও অকৃত্রিম কথা বললেন। সেগুলোর সঙ্গে এই বাঙালিত্বের অনুষঙ্গগুলো অব্যাহত রাখতে বললেন। এগুলোকে পাল্টাপাল্টি করে দাঁড় করাননি। তারা বলেছিলেন তুমি যেভাবে বাঙালী আছও এভাবেই থাক, যার কারণে দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটেছে। (চলবে)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।